মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

আইন তৈরির ক্ষেত্রে সংসদ অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়

‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ দায়মুক্তি আইন নিয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে যৌথ অভিযানকে দায়মুক্তি দেওয়ার আইন অবৈধ ও বাতিল সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদ স্বাধীন হলেও কিছু সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতাও আছে। জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়। সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সংবিধানের ‘বিধানাবলী সাপেক্ষে’। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ওই অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর কোনো সদস্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচালিত যৌথ অভিযানকে দায়মুক্তি দিয়ে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩’ জারি করা হয়েছিল। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ওই আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত  রায় দিয়েছিল। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধু সংসদের। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদ স্বাধীন। তবে এ ক্ষেত্রে সংসদের কিছু সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সংবিধানের ‘বিধানাবলী সাপেক্ষে’। জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়। কোনোভাবেই সংবিধানের বিধানাবলীর পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না সংসদ। সংসদকে কখনোই ভুল করা কিংবা ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের ক্ষমতা সংবিধানের অন্যান্য বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ যথা নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ—এই তিনটি অঙ্গই সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। অর্থাৎ তিনটি অঙ্গের কেউ সার্বভৌম নয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গই সংবিধানের বিধিবিধান মেনে চলতে বাধ্য। তবে প্রত্যেকটি অঙ্গ সংবিধানের বিধিবিধান সাপেক্ষে স্বাধীন। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু এই সংবিধানের। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মানে জনগণের শ্রেষ্ঠত্ব। জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার প্রতিফলন এই সংবিধান। রায়ে আরও বলা হয়েছে, সংবিধান সব নাগরিককে আইনগত প্রতিকার পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে এবং কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করতে পারবে না—এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এরই মধ্যে হাই কোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, বরং সবাই আইনের অধীন। যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে তাহলে তা বেআইনি ও অসাংবিধানিক। এ ধরনের কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখে।

রায়ে আদালত বলে, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। আমরা মনে করি, যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু হত্যার জঘন্যতম রূপ। যৌথ বাহিনী সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠে অভিযান পরিচালনা করেছে। আর এ ধরনের ঘটনাকে দায়মুক্তি দিয়ে জাতীয় সংসদকে আইন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাই এ আইন শুরু থেকেই বাতিল। ধরে নিতে হবে এ আইনের জন্মই হয়েছে মৃতভাবে। তাই মৃত আইনের কোনো কার্যকারিতা থাকতে পারে না।’

সম্প্রতি ৫২ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা সম্পন্ন হয়েছে। মূল রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। নিজস্ব অভিমত দিয়ে রায়ে একমত পোষণ করেছেন কনিষ্ঠ বিচারপতি। রায়ে শুধু দায়মুক্তি আইনকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের বিষয়ে আদালত রায়ে বলেছে, ‘এ জাতীয় তহবিল গঠনের আদেশ দিতে পারি না।’

২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হয়। ওই অভিযানের সময় নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের শিকার হয় কয়েকশ মানুষ। ওই অভিযানের বৈধতা দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন’ নামে একটি আইন করা হয়। এতে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এ জড়িতদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। সে অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালের ১৪ জুন একটি রিট আবেদন করেছিলেন। ওই রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে সে বছরের ২৯ জুলাই হাটকোর্ট রুল জারি করে। আইনটি কেন অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। একই সঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়। ওই রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদালতে রিট আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেছিলেন ড. শাহদীন মালিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।

সর্বশেষ খবর