বুধবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সন্দেহে পাঁচ বিষয়

তদন্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দল

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

সন্দেহে পাঁচ বিষয়

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মনজুুরুল ইসলাম লিটনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক তদন্তে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল সুন্দরগঞ্জে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক  (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক এবং গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম সুন্দরগঞ্জ থানায় পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেছেন। বর্তমানে সুন্দরগঞ্জে তদন্তে মাঠে নেমেছে পুলিশের একাধিক দল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পুলিশ লিটন হত্যাকাণ্ডের নানা বিষয় তদন্ত করছে। তদন্তে পাঁচটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। পারিবারিক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতির বিভেদ, ব্যবসা-সংক্রান্ত  অর্থনৈতিক লেনদেন, জামায়াত-শিবির এবং জঙ্গি। এ-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। শিগগিরই জড়িতদের পুলিশ শনাক্ত করতে সক্ষম হবে বলে সূত্রটি জানায়। গতকাল পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি দল সুন্দরগঞ্জের সোনারায় ইউনিয়নের ফতেহখাঁ গ্রামে এমপি লিটনের শ্বশুরবাড়িতেও যায়। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল-এ) রবিউল ইসলাম বলেন, পাঁচটি নয়, সমস্ত বিষয় নিয়েই পুলিশ তদন্ত করছে। সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান জানান, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গতকাল আরও তিনজনসহ এ পর্যন্ত ৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রথম দফায় আটক ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জনকে লিটন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। বাকি তিনজনকে অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। আদালতে যাদের পাঠানো হয়েছে তারা হচ্ছেন—মাহতাব হোসেন, আইয়ূব আলী, মহসিন আলী, সিরাজুল ইসলাম, রাতুল ইসলাম, লাল মিয়া, আলম মিয়া, ভুট্টু মিয়া, আমজাদ হোসেন, রুবেল মিয়া, আজিজুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, হাফিজ উদ্দিন, মোজাম্মেল হক ও ছানু মিয়া।

এমপি হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ : এমপি লিটন হত্যার প্রতিবাদে গতকাল সুন্দরগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। পূর্বঘোষিত তিন দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বিকালে বিক্ষোভ মিছিল শেষে পৌরশহরের বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল চত্বরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মঞ্জুর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ, পৌর মেয়র আবদুল্লাহ্ আল মামুন, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফরহাদ আবদুল্লাহ হারুন বাবলু, মাসুদুল আলম চঞ্চলসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা। বক্তারা লিটন হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এ হত্যাকাণ্ড মৌলবাদী জামায়াত-শিবির চক্র ঘটিয়েছে। হত্যায় জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।

শঙ্কা আর ভীতিতে নেতারা : দুর্বৃত্তের গুলিতে সুন্দরগঞ্জের এমপি লিটনের মৃত্যুর পর সুন্দরগঞ্জের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে শঙ্কা আর ভীতি জেঁকে বসেছে। এসব অঙ্গনের নেতারা তাদের ভয় ও শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, তারাও যে কোনো সময় হামলার শিকার হতে পারেন। লিটনের মতো একজন ব্যক্তিত্ব জামায়াত-অধ্যুষিত সুন্দরগঞ্জে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সবার জন্য স্বস্তি এনে দিয়েছিলেন। এখন তাদের মাথার ওপর থেকে সে নিরাপত্তার ছাতা সরে গেছে বলে আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা মনে করেন। সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা জানান, এখানে ১৯৯৭ সালে লিটন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। প্রথম থেকেই তিনি জামায়াত-শিবির চক্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। ১৯৯৮ সালে স্থানীয় ভুরারঘাট সিনিয়র মাদ্রাসা মাঠে গোলাম আযমের জনসভা বানচাল করে দেন তিনি। ২০০১ সালে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মানবতাবিরোধী মামলার আসামি জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুল আজিজ। তখন জামায়াত-শিবিরের দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যেও এমপি লিটন দলকে এগিয়ে নেন। ২০০৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে তিনি দলকে সংগঠিত করেন। এবারই লিটন প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত সুন্দরগঞ্জে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে চার পুলিশসহ ছয়জনকে হত্যা করে। সে পরিস্থিতিতে এমপি লিটন দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন।

সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, এমপি লিটনের তৎপরতায় সুন্দরগঞ্জে আওয়ামী লীগের পালে হাওয়া লাগে। পাশাপাশি বামধারার দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও তাদের কার্যক্রম পরিচালনার পরিবেশ পায়। তার জেদি ও সাহসী ভূমিকার কারণেই এখানে জামায়াত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বর্তমানে লিটনের অনুপস্থিতি দলের জন্য বিরাট শূন্যতা এনে দিয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ বলেন, ‘আমি টানা ৩১ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। লিটনের মতো সাহসী নেতৃত্ব সুন্দরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির জন্য অপরিহার্য ছিল। তার নিরাপত্তার ছাতা আমাদের মাথার ওপর থেকে সরে গেছে। এ অবস্থায় আমাদের ওপরও মৌলবাদী শক্তি আঘাত হানতে পারে।’ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শাখার সমন্বয়ক কৃষ্ণচন্দ্র সরকার বলেন, ‘এখানে আমরা সব সময় শঙ্কার মধ্যেই থাকি। বাম শক্তির ওপর জামায়াত তথা মৌলবাদী শক্তির আক্রোশ বেশি।’ সুন্দরগঞ্জের রামভদ্র সর্বজনীন দুর্গামন্দিরের সভাপতি ঈশ্বর চন্দ্র সরকার জানান, শীতের সময় এলাকায় অনেক স্থানে নামকীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এমপি লিটনের হত্যার ঘটনায় আয়োজকরা ভীত হয়ে থমকে গেছে।

বঙ্গবীরের সমবেদনা : এমপি লিটনের কবর গতকাল সকালে জিয়ারত করে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি নিহত এমপি লিটনের বাসায় গিয়ে তার শোকাহত পরিবারে খোঁজখবর নেন এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নিজের ঘরে যদি একজন সংসদ সদস্য নিহত হন, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়! এ হত্যার ঘটনা অত্যন্ত ভয়াবহ। সাধারণ মানুষের কোনো নিরপত্তা নেই। আগামীকাল কী হবে তা আমরা কেউ বলতে পারছি না। আর আমি যে এখানে এসেছি, রাস্তায় আক্রান্ত হব কি না সেটাও বলা যায় না। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। খুনিদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান তিনি।

এমপি লিটনের বাড়িতে দোয়া : নিহত এমপি লিটনের বাড়িতে গতকাল কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল থেকে সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহাবাজ গ্রামে এমপির নিজ বাড়ির চত্বরে কোরআন তিলাওয়াত করে পাঁচ মাদ্রাসার প্রায় দুই শতাধিক এতিম শিশু। পরে দুপুরে লিটনের কবরের পাশে আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। অনুষ্ঠিত দোয়ায় লিটনের আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন।

‘জামায়াত-শিবির চক্রই হত্যা করেছে’ : নিহত এমপি লিটনের শোকার্ত স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি শোকাহত ঘটনার পর গতকাল সাংবাদিকদের সামনে পরিস্থিতির  বিবরণ তুলে ধরেন। স্মৃতি জানান, ১৯৯৮ সালে সুন্দরগঞ্জে জামায়াত আয়োজিত জনসভায় গোলাম আযমের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। সে সময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ওই সভা পণ্ড করে দিতে লিটন তার লাইসেন্সধারী বন্দুক হাতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ওই জনসভায় প্রবেশ করে গোলাম আযমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এতে জনসভাটি পণ্ড হয়ে যায়। সেই থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী লিটনকে যে কোনো মূল্যে হত্যার টার্গেট করে রেখেছিল। সে সময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ অন্য দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এবং ফোন করে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। এমপি লিটনকে গুলি করে নির্মম হত্যা তারই জের বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ওই গোলাম আযমের দোসর জামায়াত-শিবিরের খুনিরাই তার স্বামীকে হত্যা করেছে। মর্মান্তিক এই হত্যার বিচার চেয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর