বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পুড়ল ৬০০ কোটি

রাস্তায় ব্যবসায়ীরা, মার্কেট ছাড়বেন না, এখনো বেরোচ্ছে ধোঁয়া, নাশকতার অভিযোগ অব্যাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুড়ল ৬০০ কোটি

দুই দিন পর গতকাল দুপুরেও মার্কেটের ভিতরে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত গুলশান মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দুই দিন আগেও ছিলেন বিত্তশালী। এখন অনেকে পথে বসে পড়েছেন। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী তাদের ক্ষযক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। কারণ এখনো ধসে পড়া মার্কেটের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের  হচ্ছে। কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি। তাদের মতে, গান পাউডার ছিটিয়ে হয়তো আগুন লাগানো হয়েছে। নইলে মাত্র ৩০ মিনিটে কী করে একটি এত বড় ভবন ধসে পড়ল! তাদের অভিযোগের তীর মেট্রো গ্রুপের বিরুদ্ধে। গতকালও তীব্র ক্ষোভ ছিল ব্যবসায়ীদের কণ্ঠে। এদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে, তারা তদন্ত শুরু করেছে। নাশকতামূলক তৎপরতা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক কিছু বলা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, পুড়িয়ে দেওয়া মার্কেটের দখল যে কোনো মুহূর্তে প্রভাবশালীরা নিয়ে নিতে পারে। এ কারণে তারা মার্কেটের দখল ছাড়তে নারাজ। অনেকে বলেছেন, প্রয়োজনে তাঁবু গেড়ে অবস্থান নেবেন। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল মোশাররফ হোসেন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সব দিক মাথায় রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। এটা নিছক অগ্নিকাণ্ড, নাকি নাশকতা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা দোকানমালিকদের অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছি না। পুড়ে যাওয়া দোকানগুলো থেকে আলামত সংগ্রহ করছি। সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে, কী কারণে অগ্নিকাণ্ড হলো।’

গতকালও পোড়া মার্কেটের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে ধোঁয়া বের হতে। বাতাসে ছিল পোড়া গন্ধ। কেমিক্যাল পোড়া গন্ধও পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিলেন। পোড়া মার্কেটের সামনেই রাস্তার ওপর রাতভর ঠায় বসে ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ মার্কেটের সামনে খোলা জায়গায় বিছানা-বালিশ নিয়ে এসেছেন। সেখানেই তারা অবস্থান করছেন। অনেকে ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে বেড়িয়েছেন। আশা, যদি বেঁচে যাওয়া কিছু পাওয়া যায়! গতকাল সকাল থেকে ব্যবসায়ীরা মার্কেটের সামনে জড়ো হতে থাকেন। অনেকেই বেঁচে যাওয়া মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকের আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। দুপুরে মার্কেটে মাইকিং করে বলা হয়, ব্যবসায়ীরা যেন মার্কেট না ছাড়েন। তাদের আশঙ্কা, মার্কেট ছেড়ে দিলে যে কোনো সময় বেদখল হয়ে যেতে পারে। তাদের চোখেমুখে সেই আতঙ্ক স্পষ্ট। এদিন প্রায় প্রত্যেক ব্যবসায়ীর মুখে ছিল নাশকতার অভিযোগ। তারা অভিযোগ করেন, গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের রাতে কারা সেখানে ঘোরাফেরা করেছে তাদের ধরতে পারলেই পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তারা বলেন, মেট্রো গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করতে। তারা এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান। ব্যবসায়ীরা বলেন, ঘটনার আগেই গান পাউডার ছড়িয়ে দেওয়া হয় কাঁচা মার্কেটে। আগুন লাগার মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই চারতলা ভবনটি ধসে পড়ে। আধঘণ্টার আগুনে সাধারণত ভবন ধসে পড়ার কথা না। তারা বলেন, কাঁচা মার্কেট ভবনের ব্যবসায়ী দোকানমালিকরাই তাদের পথের কাঁটা, যে কারণে তারা কাঁচা মার্কেট টার্গেট করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পশ্চিম পাশের পাকা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে মেট্রো গ্রুপ ও সিটি করপোরেশনের যোগাযোগ রয়েছে, যে কারণে তাদের ক্ষয়ক্ষতিও তেমন হয়নি। পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, নাশকতা কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যেসব বিষয়ে অভিযোগ করেছে, সেগুলোয় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, গান পাউডার ব্যবহারে যে কোনো ভবন খুব দ্রুত ধসে পড়ে। গুলশান মার্কেটটি ধসে পড়ার ধরন দেখে সে রকমই মনে হয়। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়। এদিকে আগামীকাল শুক্রবার মার্কেট খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি পাকা মার্কেটের সভাপতি এস এম তালাল রেজবী। এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী দোকান পরিষ্কার করা শুরু করেছেন। অনেকে দোকান খুলে বসেছেন। তালাল রেজবী বলেন, ‘আমরা শুক্রবার মার্কেট খুলে দিচ্ছি। এ জন্য বুধ ও বৃহস্পতিবার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলবে।’

ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, খোলা জায়গাসহ ডিএনসিসি মার্কেটটির আয়তন প্রায় ১ লাখ ৮০০ বর্গফুট। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বিস্তৃত মার্কেটটির পাশাপাশি দুটি ভবন রয়েছে। পশ্চিম দিকের দোতলা ভবনটি ‘পাকা মার্কেট’ নামে পরিচিত। এর নিচতলায় ফার্নিচার ও দ্বিতীয় তলায় পোশাক, জুতা এবং খেলাধুলার পণ্য বিক্রির খুচরা ও পাইকারি বাজার। পূর্বাংশে ‘কাঁচা ও সুপার মার্কেট’ নামের ভবনটি চারতলা। এর নিচতলায় কাঁচাবাজারের দোকান এবং ওপরের তলাগুলোতে প্রসাধন ও খাদ্যপণ্যের পাইকারি দোকান। ধসে পড়া এই ভবনে ৪০০টি দোকান ছিল। ভয়াবহ এ আগুনে ৬০০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। দুপুরে মার্কেটের প্রবেশপথে আলাদাভাবে সমাবেশ করে কাঁচা মার্কেট মালিক সমিতি ও পাকা মার্কেট দোকানমালিক সমিতি। সমাবেশ থেকে এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও ক্ষতিগ্রস্তদের দোকান বরাদ্দ দিয়ে এরপর নির্মাণকাজ শুরুর আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতির অভিযোগ তোলেন তারা। তাদের দাবি, ফায়ার সার্ভিসের ২২ বা ২৩টি ইউনিটের কথা বলা হলেও আসলেই এতসংখ্যক এসেছিল কি না, গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তা তদন্ত করতে হবে। কাঁচাবাজার মার্কেট মালিক সমিতির সমাবেশে ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘আমরা এখানেই থাকব। ব্যবসা করব। আমাদের তো সব শেষ। কিছুই নেই। এখন চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। কাঁদতেও পারছি না।’ ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩০০ দোকানমালিক এ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘আমরা এই মার্কেট ছেড়ে কোথাও যাব না। যারা পরিকল্পিতভাবে আগুন ধরিয়েছে তাদের গ্রেফতার করতে হবে।’ কাঁচাবাজার মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ বলেন, ‘কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা আমরা জানি।’ তিনি পাকা মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি তালাল রেজবীকে দালাল আখ্যায়িত করে বলেন, ‘আপনি দালালি করবেন না। তাহলে মার্কেটে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’ শের মোহাম্মদ বলেন, ২০০৩ সালে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময় মার্কেটের জায়গায় পিপিপির আওতায় ১৮ তলা গুলশান ট্রেড সেন্টার নির্মাণের দরপত্র দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েও তা করতে অপারগতা জানালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা মেট্রো গ্রুপের আমিন অ্যাসোসিয়েটস ওভারসিজ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ওই চুক্তিতে বলা হয়, ভবনের আটতলা পর্যন্ত থাকবে দোকান, ৯ থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত হবে অফিস। দুই হাজার ২৪টি দোকানের মধ্যে ডিসিসি পাবে ২৭ শতাংশ। আর আমিন অ্যাসোসিয়েটস ৭৩ শতাংশ দোকান পাবে এবং তা বিক্রি করে লাভ তুলে নেবে। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই চুক্তি স্থগিত করে ভবনে ডিসিসির মালিকানা বাড়াতে বলা হয়। এরপর ডিসিসির মালিকানা বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করে নতুন চুক্তি হয়। কিন্তু দোকান মালিক সমিতি এরপর মামলা করলে ঠিকাদার কোম্পানি সেখানে আর ভবন তুলতে পারেনি বলে জানান ডিসিসি কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মচারী এবং মেট্রো গ্রুপ এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত। ডিসিসি পাকা মার্কেটের দোকানমালিক সমিতির সহ-সভাপতি জয়নাল আবেদিনও একই সন্দেহের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। একটি দোকানের মালিক বাবু বলেন, ‘মার্কেট বিক্রি হয়েছে কয়েকবার। ভাঙতে না পেরে আগুন দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে কেউ আগুন দিয়েছে।’ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের ছিল খেলনার দোকান। দুই দিন আগে নতুন মাল তুলেছিলেন তিনি। দেলোয়ার বলেন, ‘একটা সুতাও বের করতে পারিনি। সব ছাই হয়ে গেছে। যারা মার্কেট ভাঙার ষড়যন্ত্র করছিল তারাই আগুন দিয়েছে। এই মার্কেটটা ঘিরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হতো। সবার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’ ডিএনসিসি কাঁচা মার্কেটের নিচতলায় মা রেক্সিন হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুস সালাম। তার নিজেরই পাঁচটি ক্রোকারিজের দোকান ছিল। সবগুলোই আগুনে পুড়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত কোনো একটি সামগ্রী বের করতে পারেননি তিনি। এ প্রসঙ্গে আবদুস সালাম জানান, তার দোকানে দেশি-বিদেশি ফ্লোরম্যাট, রেক্সিন, টেবিলম্যাট, কার্পেট, পাপস রুল, ওয়ান টাইম আইটেম সিলভার ও মেলামাইন, সিরামিকস, প্রেশার কুকার, ব্লেন্ডারসহ যাবতীয় ক্রোকারিজের মালামাল পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হতো। বেলা ২টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেট ঘুরে দেখেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানমালিকদের সহায়তা দেওয়া হবে। ‘সরকার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সবাই আপনাদের পাশে আছি’—ব্যবসায়ীদের বলেন তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানমালিকদের জন্য তার মালিকানাধীন ফারমার্স ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ দেবে বলেও জানান মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর