বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংসদ সদস্য হত্যা মেনে নেওয়া যায় না, বিচার হবে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংসদ সদস্য হত্যা মেনে নেওয়া যায় না, বিচার হবে : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনের ওপর জামায়াতের ক্ষোভ ছিল। তিনি গাইবান্ধায় গোলাম আযমের প্রবেশে বাধা দিয়েছিলেন। তাকে বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। অবশেষে তারা সেই হত্যাকাণ্ডটা ঘটাল। শেখ হাসিনা বলেন,  স্বাধীনতার পক্ষশক্তির পক্ষে থাকার কারণেই লিটনকে জীবন দিতে হয়েছে। তার হত্যাকাণ্ড আমরা মেনে নিতে পারি না। এই হত্যার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের এক যৌথসভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি-জামায়াত এখন গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে তাদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ হত্যা করা বিএনপির চরিত্র। লিটন হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত, তাদের যেভাবে হোক খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। আর সাংবাদিকদের বলব, চরিত্র হনন করতে চাইলে করেন, কিন্তু একটা মানুষের জীবন যাবে, এ ধরনের ঘটনা না ঘটানোই ভালো। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হলো যে, তিনি একটা মহাঅপরাধী। যেহেতু তিনি গোলাম আযমকে বাধা দিয়েছেন, যেহেতু জামায়াতকে বাধা দিয়ে সেখান থেকে তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েছেন, সেখানে তিনি জামায়াতবিরোধী একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন, সে কারণেই তাকে জীবন দিতে হলো। প্রধানমন্ত্রী গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যাই হোক আমি জানি না, ওদের (বিএনপি-জামায়াত) আরও কী পরিকল্পনা আছে। তারা নির্বাচন করল না, নির্বাচন ঠেকাতেও পারেনি। আন্দোলন করে সরকার উত্খাতে ব্যর্থ হয়ে এখন গুপ্তহত্যা। এটা তো বিএনপি-জামায়াতের চরিত্র। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়ার চরিত্রই হচ্ছে অপরাধীদের মদদ দেওয়া, অপরাধীদের লালন-পালন করা। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, লিটন হত্যাকাণ্ড আমরা মেনে নিতে পারি না। সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের স্থান হবে না। এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

গত কয়েক বছরে গাইবান্ধায় বিএনপি-জামায়াতের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, গাইবান্ধা এমন একটা জায়গা, বিশেষ করে সুন্দরগঞ্জ, একেবারে জামায়াতের একটা সন্ত্রাসী এলাকা। ওই এলাকাতে একসময় জামায়াতের এমপিও ছিল। সেখানে আওয়ামী লীগ করা যায়— এমন অবস্থাও ছিল না। আর বিএনপির আন্দোলন হচ্ছে জ্বালাও-পোড়াও মানুষ হত্যা করা। এই মানুষ হত্যা গাইবান্ধায় সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরগঞ্জে জামায়াত যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, আওয়ামী লীগের প্রায় দেড়শ থেকে দুইশ নেতা-কর্মীর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে এবং পুড়িয়ে দেয়। রেললাইনের ফিসপ্লেট তুলে চারজনকে হত্যা করে। পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দিয়ে লুটপাট করে চার পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে তারা প্রকাশ্যে ঢাকা-রংপুর রাস্তা অবরোধ করে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে। তারা নয়জন মানুষকে পুড়িয়ে মারে। ওই পুরো এলাকাটা তাদের কব্জায় ছিল। এরপর ২০১৫ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত অবরোধ চলাকালেও ওই এলাকায় প্রচণ্ড তাণ্ডব হয়। প্রয়াত সংসদ সদস্য লিটনের স্মৃতিচারণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, লিটন ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে তিনি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা আনার পর আওয়ামী লীগ করা শুরু করে। ওখানকার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আমরা তাকে মনোনয়ন দিই। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। লিটনের ওপর একাধিকবার হামলা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা ঘটনা আমার খুব খারাপ লাগে। মাঝখানে একটা ঘটনা ঘটে গেল, একটা বাচ্চা ওর গুলিতে আহত হয়। সেটা নিয়ে পত্র-পত্রিকা এমনভাবে লেখালেখি করল, ঘটনা যেটা ঘটল, সেটা আর কেউ তুলে ধরল না যে, ওকে মারার জন্য ‘অ্যাম্বুশ’ করা হয়েছিল। যেহেতু তিনি সব সময় সতর্ক থাকতেন, তাই কোনোমতে সেখান থেকে তিনি বেঁচে আসেন। গোলাগুলিতে যে ছেলেটা আহত হয়, বাচ্চা, সেও আমাদের আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল। কিন্তু সেই ঘটনাটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে লেখা হয়, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, তার বন্দুকের লাইসেন্স জব্দ করা হয়। তার অস্ত্রটা নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি আতঙ্কে থাকতেন, যে কোনো সময় তাকে আক্রমণ করবে। ঠিক সেই ঘটনাই ঘটল। তার বাসার ভিতরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আমি যখন বিরোধী দলে তখন আমাদের সংসদ সদস্য শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হলো। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পর আমাদেরকে সংসদে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও করতে দেওয়া হয়নি। একটা নিন্দা প্রস্তাব, একটা শোক প্রস্তাবও তুলতে দেওয়া হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্তির বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল। আর ১২ তারিখ আমরা শপথ নিয়েছিলাম। আমাদের তিন বছর পূর্ণ হলো। এই তিন বছর আমরা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছি। দেশের উন্নয়নের গতি আমরা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, আমির হোসেন আমু, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ভিডিও কনফারেন্স : গতকাল সকালে গণভবন থেকে রংপুর বিভাগের আট জেলার জনগণের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। জেলাগুলো হলো— রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও গাইবান্ধা।

এ সময় এমপি লিটন হত্যার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, লিটন সব সময় এলাকায় মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করেছেন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রংপুরবাসীকে বলব, কোনোমতেই যেন সেখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দানা বাঁধতে না পারে। রংপুর বিভাগে আমরা দেখেছি, ২০১৩ সালে যে তাণ্ডব হয়েছে, সেখানে মানুষ হত্যা করা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা, গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। তারা বাসে, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, পুলিশ হত্যা করেছে।’ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে জঙ্গিবাদের ঠাঁই নেই। কে ভালো, কে মন্দ তার বিচার করবেন আল্লাহ। মানুষ খুন করে কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ‘২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে এ দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে পদক্ষেপ নিই। আমরা বিভিন্ন ভাতা চালু করি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করি।’ তিনি বলেন, ‘এলাকা ধরে ধরে নিরক্ষরতামুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু বিএনপি আবার ক্ষমতায় এসে সব বন্ধ করে দেয়। আবার খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়, সাক্ষরতার হার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায়।’

একই অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দরকার। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া কোনো দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলটি যখন একনেকে আসে, এটি ছিল ৬০০ আসনবিশিষ্ট। আমি তা ১ হাজার আসনবিশিষ্ট করে দিই। আমরা আশা করি, ছাত্রীসংখ্যা আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে আমরা বিজ্ঞানের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিই। আর গবেষণাটা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে আমরা এই গবেষণা ইনস্টিটিউট (ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। এটি আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রংপুর সব সময় একটি অবহেলিত জেলা ছিল। সেখানে সব সময় দুর্ভিক্ষ লেগে থাকত। আমি বিভিন্ন সময় রংপুর গিয়েছি। আওয়ামী লীগ থেকে সেখানে ত্রাণ নিয়ে যেতাম, লঙ্গরখানা খুলতাম। যখনই আমরা ক্ষমতায় এসেছি, চেষ্টা করেছি ওই অঞ্চলের জনগণ কীভাবে একটু ভালো থাকতে পারে। সেই চিন্তা থেকেই আমরা রংপুর বিভাগ ঘোষণা করি। কারণ একটি বিভাগ করলে, বিভাগীয় অবকাঠামো গড়ে উঠলে, এলাকার অনেক উন্নতি হয়। সেই চিন্তা থেকেই রাজশাহী বিভাগকে দুই ভাগ করে রংপুরকে একটি আলাদা বিভাগ করে দিই।’

গবেষণার জন্য ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও মেয়েদের জন্য অত্যাধুনিক শেখ হাসিনা হলের বাজেট ২০১৫ সালের একনেকে পাস হয়। রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্য ৫১ কোটি ২৩ লাখ ও মেয়েদের হলের জন্য ২৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে এ স্থাপনা দুটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর