শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
বাবা বললেন, উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে আফসোস নেই

মারজান-সাদ্দাম বন্দুকযুদ্ধে নিহত

গুলশান জঙ্গি হামলা ও জাপানি নাগরিক হত্যায় মাস্টারমাইন্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক

মারজান-সাদ্দাম বন্দুকযুদ্ধে নিহত

মারজান - সাদ্দাম

পতন ঘটেছে নব্য জেএমবির প্রধান জঙ্গি নেতা মারজান এবং তার সহযোগী সাদ্দাম হোসেনের। বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতে রাজধানীর রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের কাছে কাউন্টার টেররিজম পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুজনই নিহত হয়েছেন। গুলশান  হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ মারজান এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওসহ ১০ মামলার আসামি সাদ্দামকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু পুলিশের ঘুমকে হারাম করে দেওয়া ভয়ঙ্কর এই দুই জঙ্গি নেতা রাজধানীসহ সারা দেশে জঙ্গিদের সংগঠিত করছিল। গড়ে তুলছিল জঙ্গি আস্তানা। নব্য জেএমবির প্রথম সারির এই দুই দুর্ধর্ষ নেতার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে স্বস্তি ফিরে আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। আর এর মধ্য দিয়ে জঙ্গি নির্মূলে আরও একধাপ দেশ এগিয়ে গেল বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল সকালে বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মারজান ও সাদ্দাম। তিনি বলেন, মারজানকে গুলশান হামলার পর থেকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল। আর সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল ছিলেন উত্তরাঞ্চলের নব্য জেএমবির প্রধান। রংপুরে হোশি কোনিওসহ পাঁচটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি তিনি। নব্য জেএমবির অস্ত্রের জোগানদাতাও ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের অভিযানে নব্য জেএমবির প্রধান কানাডীয় পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি নাগরিক তামিম চৌধুরী অপর দুই সহযোগীসহ নিহত হওয়ার পর মারজান সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এর আগে মারজান ছিলেন সংগঠনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও সামরিক প্রশিক্ষক। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গত বছর জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যার ঘটনার পর তদন্তের মধ্যে মারজানের নাম আসে। গুলশানে হলি আর্টিজানে যখন হত্যাযজ্ঞ চলছিল তখন জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় মারজানের। হত্যাযজ্ঞের পর জঙ্গিদের মোবাইলে ‘ধন্যবাদ’ লিখে এসএমএস পাঠিয়েছিলেন তিনি। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তিনি নিজেই। হামলায় তার ভূমিকা ছিল অপারেশন কমান্ডার হিসেবে। পুরো অভিযান তিনি রেস্তোরাঁর বাইরে থেকেই পরিচালনা করেন। নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ এই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেই হলি আর্টিজানের ভিতর থেকে রক্তাক্ত লাশের ছবি বাইরে পাঠানো হয়েছিল, যা দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার সময় তিনি রেস্তোরাঁর আশপাশেই অবস্থান নেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। হলি আর্টিজানের পাঁচ হামলাকারীর প্রশিক্ষকও ছিলেন এই মারজান।

১০ মিনিটের বন্দুকযুদ্ধ : বহু নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে সারা দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও মাত্র ১০ মিনিটের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন জঙ্গি নেতা মারজান ও সাদ্দাম। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার (ডিসি) মহিবুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন কয়েকটি সড়কে চেকপোস্ট বসায় পুলিশ। রাত আড়াইটার দিকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে একটি মোটরসাইকেলে দুজন যাচ্ছিলেন। তাদের একজনের পরনে ছিল খয়েরি রঙের গেঞ্জি ও জ্যাকেট। আরেকজনের গায়ে ছাই রঙের গেঞ্জি ও আকাশি রঙের জ্যাকেট। তাদের দেখে সন্দেহ হলে থামতে বলে পুলিশ। তবে তারা মোটরসাইকেল না থামিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে দুই থেকে তিনটি গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় তারা মাটিতে পড়ে যায়। পরে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল থেকে তাদের ব্যবহূত মোটরসাইকেল, একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি ও কিছু বিস্ফোরক জব্দ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ঢামেকে তাদের দুজনের পরিচয় অজ্ঞাত দেখানো হলেও সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারা মারজানকে শনাক্ত করেন। পরে নিহত মারজানের আরেক সহযোগী সাদ্দামকেও শনাক্ত করে পুলিশ। তাদের লাশ মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায়। আজ তাদের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।

নিহত হলেও এত দিন মারজান কোথায় ছিলেন এ নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীসহ সারা দেশে জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নব্য জেএমবির গ্রুপটি। রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যে দ্রুত আস্তানা পরিবর্তন করে তারা। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘সে কোথায় ছিল তা এখনো আমরা নিশ্চিত না। তবে আমাদের কাছে খবর ছিল মারজান মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে যাবে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা এখানে অবস্থান নিই।’

কে এই মারজান : মারজানের পুরো নাম নুরুল ইসলাম মারজান। পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়া গ্রামের হোসিয়ারি শ্রমিক নিজাম উদ্দিনের ছেলে মারজান পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর পাবনা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর পাবনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত বছর আগস্টে পুলিশ গুলশান হামলার সন্দেহভাজন হিসেবে মারজানের নাম ও ছবি প্রকাশের পর তার বাবা ওই ছবি নিজের ছেলের বলে শনাক্ত করেন। সে সময় সাংবাদিকদের মারজানের বাবা বলেন, ছেলের বিয়ের খবর পেলেও আট মাস ধরে পরিবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরবি বিভাগের ছাত্র মারজান ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রাখেন। এরপর আর ভর্তি হননি তিনি। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে পুলিশি তল্লাশিতে উদ্ধার কয়েকটি ল্যাপটপ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নথিপত্র পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, মারজান ছিলেন ওই সংগঠনের একজন সাথী। মারজানের স্ত্রী প্রিয়তিও এখন কারাগারে বন্দী। ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে এক নারী জঙ্গি আস্তানা থেকে তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মারজানের কারণেই প্রিয়তি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিলেন। সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের হাতে আটক প্রিয়তি স্বামী মারজানকে ‘অত্যন্ত স্বৈরাচারী’ মেজাজের লোক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নিজের সব ইচ্ছা তিনি স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিতেন। প্রিয়তি তার মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। লেখাপড়াও তেমন জানা নেই। তাকে দেখার মতো কেউ ছিল না। জঙ্গি মতাদর্শে না গেলে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাবে এমন ভয় কাজ করত। মনিরুল বলেন, ওই নারী বলেছেন, তিনি মন থেকে কখনই জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাস করেন না। এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যারা মানুষের ক্ষতি করে, তাদের আদর্শকে তারা কোনো দিন সমর্থন করেন না। এর পরও স্বামীর চাপে বাধ্য হয়ে তারা জঙ্গিদের সঙ্গে ছিলেন।

কে এই সাদ্দাম : ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারী গ্রামে জাপানি নাগরিক  হোশি কোনিওকে হত্যার মাধ্যমে কিলিং মিশন শুরুর ঘোষণা দেয় নব্য জেএমবি। এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয় সাদ্দামকে। ওই হত্যাকাণ্ডে করা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিও ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাদ্দাম নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি। উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে নব্য জেএমবি যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এর বেশির ভাগের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। সাদ্দাম জঙ্গিদের কাছে বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত ছিলেন। জাপানি নাগরিক হত্যা মামলার চার্জশিটে তার চারটি নাম দেওয়া হয়েছে। আসল নাম সাদ্দাম হোসেন ছাড়াও রাহুল, চঞ্চল, সবুজ ও রবি নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন জঙ্গিদের কাছে। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম ব্যবহার করতেন। চার্জশিট অনুযায়ী, সাদ্দামের বাবার নাম আলম মিয়া ওরফে জোলা। মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চরবিদ্যানন্দ গ্রামের দোতলা মসজিদের কাছে। জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে হত্যার পর রংপুরের কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা, পঞ্চগড়ের মঠ অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে হত্যা, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে হত্যা এবং বাহাই নেতা রুহুল আমিনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রেও সাদ্দামকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া গাইবান্ধার চিকিৎসক দীপ্তি, জঙ্গি সদস্য ফজলে রাব্বি, ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত হত্যা এবং নীলফামারীতে মাজারের খাদেম ও দিনাজপুরে এক চিকিৎসককে হত্যাচেষ্টা মামলায়ও আসামির তালিকায় তার নাম রয়েছে বলে কাউন্টার টেররিজম পুলিশের ভাষ্য। সাদ্দামকে ধরার করার জন্য পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েও গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের শীর্ষ স্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গি সাদ্দাম জেএমবির প্রথম সারির নেতা ছিলেন। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবি যতগুলো কিলিং অপারেশন পরিচালনা করেছে, এর বেশির ভাগেরই মূল পরিকল্পনাকারী ও অস্ত্রের জোগানদাতা ছিলেন তিনি। সাদ্দাম পঞ্চগড়ে মন্দিরের পুরোহিত হত্যাসহ রংপুর বিভাগে বিভিন্ন কিলিং মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ফলে তার নিহত হওয়ার ঘটনা জঙ্গিবিরোধী অভিযানের একটা বড় সাফল্য বলেই মনে করছে পুলিশ।’

মারজানের বাবা খুশি : এদিকে পাবনা থেকে সংবাদদাতা জানান, জঙ্গি নেতা মারজানের নিহতের খবরে পাবনায় তার গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। গৃহিণী মা সালমা বেগম (৫০) ও দাদি পিয়ারুন্নেছা (৮০) মারজানের শোকে শয্যাশায়ী। তবে মারজানের বাবা শ্রমিক নিজাম উদ্দিন বলেছেন, ‘ওর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে, যা হওয়ার হয়েছে। আমার আফসোস নেই। কিন্তু সরকার মরদেহটা ফেরত দিলে নিজের গ্রামে ওকে দাফন করতে চাই।’ টিভিতে নিউজ দেখে এবং পরে স্থানীয় পুলিশের মাধ্যমে পরিবার জানতে পারে, মারজান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। এ খবর পাওয়ার পর মা সালমা বেগম, দাদি পিয়ারুন্নেছা শোকে ভেঙে পড়েন। ছোট ভাইবোনরাও কান্নাকাটি করছে। মারজানের বাবা বলেন, ‘এত কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি। সেই ছেলে এই অপকর্ম করতে পারে তা বিশ্বাস করতে পারছি না। ও অপরাধ করলে ওর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।’ নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ওকে এই পথে যারা নিয়ে গেছে তাদেরও আমি বিচার চাই।’

 

সর্বশেষ খবর