মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদেশে বই ছাপিয়ে বিপাকে এনসিটিবি

অনেক স্থানে ছাত্রছাত্রীরা এখনো বই পায়নি দুই কর্মকর্তা ওএসডি তিন সদস্যের কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দিতে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও সময়মতো সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ ছাড়া নিম্নমানের কাগজ ও পাঠ্যবইয়ে নানা ভুলভ্রান্তি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও বিদেশে ছাপানো প্রাথমিকের ৪৭ লাখ বই এখনো বিদ্যালয়ে পৌঁছেনি। দরপত্রে বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী বই সরবরাহ করতে পারেনি দেশি অনেক মুদ্রাকরও। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে একটি-দুটি বই তুলে দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এসব বইয়ের নিম্নমানের কাগজ অতীতের সব রেকর্ড যেন ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে বিপাকে খোদ এনসিটিবি।

রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে বই উৎসব করা হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে। কোনো স্কুলে বই দেওয়া হয় একটি-দুটি করে। অনেক শিক্ষার্থীর        হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুরনো বই। রাজধানীর অনেক স্কুলেও        এক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই সংকটের কারণে অন্য শ্রেণির বই দিয়ে বই উৎসব পালন করা হয়েছে। আর    ইংলিশ ভার্সন বইয়ের সংকট চরমে রয়েছে স্কুলে স্কুলে। নিম্নমানের কাগজ ও পাঠ্যবইয়ে নানা ভুলভ্রান্তি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে বিদেশে ছাপা হওয়া বিপুলসংখ্যক বই এখনো বিদ্যালয়গুলোতে পৌঁছেনি। তবে এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলছেন, বই ছাপাতে বিদেশের প্রতি নির্ভরতা কমালে বই সংকটের সমস্যা পোহাতে হতো না। এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যা সমস্যা হওয়ার হয়েই গেছে। নৌপথে বই আসতে গিয়েই বেধেছে বিপত্তি। সময় লেগেছে বেশি। শিগগিরই বইগুলো স্কুলে স্কুলে পৌঁছে যাবে। তবে কেউ দায়ী থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এবার মোট ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপিয়েছেন দেশীয় মুদ্রাকররা। আর প্রাথমিক স্তরের ১১ কোটি ৫৫ লাখ ২৬ হাজার ৯৫২টি বই ছাপানো হয়েছে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে। দেশীয় মুদ্রাকরের পাশাপাশি এবার বই ছাপানো হয়েছে ভারত ও চীনে। দরপত্র অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে এসব বই পৌঁছানোর কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বিদেশে ছাপা প্রাথমিক স্তরের প্রায় ৪৭ লাখ বই বিদ্যালয়ে পৌঁছেনি। সূত্রমতে, বই উৎসবের পর দশ দিন পার হতে চললেও বিদেশে ছাপানো প্রাথমিকের ৪৭ লাখ বই এখনো বিদ্যালয়ে পৌঁছেনি। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভারতের শীর্ষাসাই বিজনেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৪৭ লাখ বই ছাপার কাজ করেছে। সেই বইগুলো এখনো পৌঁছেনি। অথচ ডিসেম্বরের মধ্যেই এসব বই সরবরাহের কথা ছিল। এই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান এনসিটিবিকে জানিয়েছে, ভারত মহাসাগরে অন্ধ্র প্রদেশে ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজ। এ জন্যই দেরি হয় পণ্য পরিবহনে। তবে এনসিটিবি বই সরবরাহের এ কারণকে আমলে না নিয়ে খতিয়ে দেখতে চায়। জানা গেছে, বই সরবরাহকারী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। সেখান থেকে পণ্য খালাস করে স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দিতে আরও কিছুদিন সময় লেগে যাবে। সময় অনুযায়ী বই সরবরাহ করতে পারেনি দেশি অনেক মুদ্রাকরও। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে একটি-দুটি বই তুলে দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এসব বইয়ের নিম্নমানের কাগজ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকার প্রিন্টার্স নামে দেশি একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ বই ছাপার কাজ নিলেও এখনো পর্যন্ত নয় লাখ বই দিতে পারেনি। গত বছরও নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো, বিলম্বে বই দেওয়া, ছাপার মানসহ অন্য কারণে সরকার প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিংকে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৬১ টাকা জরিমানা করা হয়। বই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় বিভিন্ন জেলায় আপদকালীন মজুদ থেকে বই পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এদিকে রাজধানীসহ সারা দেশের স্কুলে স্কুলে বই সংকটের বিষয়কে আমলে নিয়ে পিএলআই (পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন) কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি। আজ থেকেই এ কমিটি কাজ শুরু করবে।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ করতে না পারায় ৭২টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ৩৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিল আটকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিম্নমানের কাগজ সরবরাহ করায় চারটি প্রতিষ্ঠানের ৩৬ কোটি টাকার বিল আটকে দেওয়া হয়েছে। এনসিটিবির এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘৩৮ জেলা থেকে আপদকালীন বই সংগ্রহ করে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী পাঠানো হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে বই দেওয়ার কথা থাকলেও বিদেশি কোম্পানি কথা রাখেনি। এর জন্য তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এনসিটিবির দুই কর্মকর্তা ওএসডি : নতুন পাঠ্যপুস্তকে নানা অসঙ্গতি আর ভুলের ঘটনায় এনসিটিবির দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার এবং ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে ওএসডি করা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে। এ ছাড়া আজ বেলা ১১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। জানা গেছে, পাঠ্যপুস্তকের নানা ভুল আর অসঙ্গতি বের করতে ও দোষীদের খুঁজে বের করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ ক্ষতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মাহমুদুল ইসলাম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) এলিয়াছ হোসেন। এ কমিটিকে আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর আগে পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে ফেসবুকে তীব্র সমালোচনার পর ওইসব ভুলত্রুটি পর্যালোচনায় একটি কমিটি করে এনসিটিবি।

সর্বশেষ খবর