মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাড়ছে হুন্ডি কমছে রেমিট্যান্স

কঠোর নজরদারিতে মোবাইল ব্যাংকিং

মানিক মুনতাসির

ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রতিদিনই কমছে। অথচ বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। যদিও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার অপব্যবহার করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। শুধু যে রেমিট্যান্সের অর্থই হুন্ডির মাধ্যমে আসছে তা নয়। অবৈধ ব্যবসা-মানব পাচারসহ আরও বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের অর্থও হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে। আবার দেশ থেকে বেরিয়েও যাচ্ছে। সেই টাকা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, সিঙ্গাপুর, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে একটি চক্র। আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা না বাড়ায় পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর ব্যাংকিং চ্যানেল ঝামেলাপূর্ণ মনে করায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ও এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে কঠোর নজরদারির মধ্যে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

সম্প্রতি লন্ডন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ঘুরে এসেছেন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছেন। এজন্য এসব দেশের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি কনিউনিটিগুলোতে বিভিন্ন ফোন কোম্পানি পরিচালিত মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করা হয়েছে। সেসব শহরে রীতিমতো দোকান খুলে বসেছেন অনেকেই। এসব তথ্য অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকও সংগ্রহ করেছে। ইতিমধ্যে কোন কোন মোবাইল কোম্পানি বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের টাকা দেশে আনছে সেগুলোর তালিকাও করা হয়েছে। এসব মোবাইল অপারেটরকে নোটিসও করা হয়েছে। হুন্ডি বন্ধে এজন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইন অনুযায়ী রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলেই আসতে হবে। কেউ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা আনলে তা হবে আইন-বহির্ভূত। কোনো মোবাইল কোম্পানি এ ধরনের কাজ করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের পর নভেম্বর মাসেও কমেছে প্রবাসী আয়। নভেম্বরে প্রবাসীরা দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৯৫ কোটি ১৩ লাখ মার্কিন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ কোটি ডলার বা ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ কম। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুরো অর্থবছরেই কমেছে রেমিট্যান্স। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা আগের অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। অথচ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যানুসারে, গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ ২২ হাজার ১০০ জন। এর আগে ২০১৫ সালে ৫ লাখ ৫৫ হাজার জনশক্তি রপ্তানি হয়। ২০১৪ সালে রপ্তানি হয় ৪ লাখ ২৫ হাজার এবং ২০১৩ সালে হয় ৪ লাখ ৯ হাজার। সেই হিসাবে ২০১৩ সালের পর আবার জনশক্তি রপ্তানি বড় সংখ্যায় বেড়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া রেমিট্যান্স তথ্যানুসারে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) প্রবাসী আয় এসেছে ৫২০ কোটি ডলার। আগের (২০১৫-১৬) অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৬১৭ কোটি ডলার।

এ হিসাবে গত পাঁচ মাসে ৯৭ কোটি ডলার বা ১৫.৭২ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে। সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দর পড়ে যাওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সুবিধাজনক অবস্থানে না থাকায় সেখানকার শ্রমিকদের কাজের সুযোগ ও আয় কমে গেছে। কিছু দেশে ডলারের বিপরীতে মুদ্রা বিনিময় হার কমে যাওয়ার কারণে আগের মতো অর্থ পাঠাতে আগ্রহ পাচ্ছে না প্রবাসীরা। এর বাইরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে হুন্ডি কারবারির সংখ্যা ও পরিধি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিংগুলোর বেআইনি দোকান চালিয়ে অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে কমেছে রেমিট্যান্স। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক  অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে, কিন্তু কমছে রেমিট্যান্স। এর প্রধান কারণ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে ৫০ শতাংশ টাকা দেশে আসছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হুন্ডির মাধ্যমে। সিঙ্গাপুরেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেড়েছে হুন্ডির প্রচলন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর