বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পালিয়ে বেড়ান ব্যাপারটা কী

সোহরাওয়ার্দীতে বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

পালিয়ে বেড়ান ব্যাপারটা কী

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় গতকাল নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

যারা আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানায়, জঙ্গিবাদ উসকে দেয় তাদের মুখে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্র সুরক্ষার কথা মানায় না। এরা হত্যাকারী, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী। প্রধানমন্ত্রী গতকাল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় সভাপতির ভাষণ দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ সভার আয়োজন করে। সভা শুরুর নির্ধারিত সময় বিকাল ৩টার আগেই কানায় কানায় ভরে যায় সভাস্থল। প্রধানমন্ত্রী ৩টা ২৫ মিনিটে মঞ্চে এসে হাত নেড়ে জনতাকে অভিবাদন জানান। জনতাও দুই হাত নেড়ে তাকে শুভেচ্ছা জানায়। প্রধানমন্ত্রী তার ৪৫ মিনিটের ভাষণে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তীব্র সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতিমের নামে আসা টাকা তিনি চুরি করে খেয়েছেন। সেই মামলায় হাজিরা দিতে যান। এক দিন যান তো ১০ দিন যান না। পালিয়ে বেড়ান। ব্যাপারটা কী! এতেই তো ধরা পড়ে যায় যে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। তিনি বলেন, এতিমের টাকা চুরি করে খায়, শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে, তার কাছে শিখতে হবে রাজনীতি! গণতন্ত্রের ভাষা শিখতে হবে! প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ এখন শান্তিতে আছে, স্বস্তিতে আছে। তারা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে। মানুষ যখন ভালো থাকে, তখন তার অন্তর্জ্বালা হয়। এটাই দুর্ভাগ্যের। জনসভায় আরও বক্তৃতা করেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা মো. আবু কাওছার, শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন প্রমুখ। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন জনসভা পরিচালনা করেন। জনসভায় যুবলীগের শোডাউন সবার দৃষ্টি কাড়ে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিকের নেতৃত্বে বিশাল মিছিলও ছিল বর্ণাঢ্য। অন্যদিকে ঢাকার এমপি আসলামুল হক আসলাম, হাবিবুর রহমান মোল্লা, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সংরক্ষিত আসনের এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাবেসক লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মিজানুর রহমান, দক্ষিণের সভাপতি বায়েজিদ আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ, সফিকুর বাহার মজুমদার টিপুর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটি এবং ঢাবির বিভিন্ন হল শাখার নেতাদের শোডাউনও ছিল দেখার মতো। বিএনপি-জামায়াত প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, সন্ত্রাস-নাশকতা-জঙ্গিবাদ ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যার জন্য দেশের জনগণ একদিন গণআদালতে তাদের বিচার করবে। এ দেশের মাটিতে কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। তিনি বলেন, আজকের ঐতিহাসিক দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা— আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবই ইনশা আল্লাহ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যায়, আর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলেই দেশ পিছিয়ে যায়। বিএনপির দোসর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত। যেসব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সেই দণ্ড কার্যকরও হয়েছে। খালেদা জিয়া তাদেরই তার মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কীভাবে একজন মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানায়! এরা কীভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে! ক্ষমতায় থেকে এরা খুন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, অর্থ ও অস্ত্র পাচার, দুর্নীতি ছাড়া দেশকে আর কিছুই দিতে পারেনি। এরা লুটপাটেই ছিল ব্যস্ত, দেশের উন্নয়ন করবে কী! আমরা বিদ্যুৎ দিয়েছি, আর বিএনপি দিয়েছে খাম্বা। খাম্বা আছে বিদ্যুৎ নেই, এটাই ছিল ওই সময়ে বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারা। ২০১৩, ’১৪ ও ’১৫ সালে বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার আন্দোলন মানেই মানুষ হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ আর নাশকতা। নির্বাচন ঠেকানোর নামে নির্বিচারে পুড়িয়ে তিনি মানুষ খুন করিয়েছেন। হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে ২০১৫ সালে আবার শুরু করলেন তাণ্ডব। গুলশানের বাসা ছেড়ে গুলশানের অফিসে উঠলেন এবং খালেদা জিয়া বললেন সরকার উত্খাত না করে উনি ঘরে ফিরবেন না। এরপরই উনি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করলেন। ২৩১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছেন খালেদা জিয়া।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু হত্যাযজ্ঞই নয়, আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত ২৯টি রেলের বগি, ১১টি লঞ্চে অগ্নিসংযোগ করেছে, ফিশপ্লেট উপড়িয়ে নাশকতা চালিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৩ জনকে হত্যা করেছে। এমনকি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আগুন দিয়ে শত শত কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে। এটাই ছিল খালেদা জিয়ার আন্দোলন। কিন্তু জনগণ যখন তাদের প্রতিহত শুরু করল, জনগণের ধাক্কায় খালেদা জিয়া দলীয় কার্যালয় ছেড়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে, বিপথে চলে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, পবিত্র ধর্ম। ইসলামে মানুষ হত্যা শেখায় না। শেষ বিচারের মালিক একমাত্র রাব্বুল আলামিন। ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস চালাচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে, আত্মঘাতী হচ্ছে তারা কখনই বেহেস্তে যাবে না, তারা যাবে দোজখে। দেশের সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে— এটাই আমরা চাই। এজন্যই সরকার সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্মরণ করে আবেগাগ্লুত কণ্ঠে বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে পরিবারের কাছে না গিয়ে ছুটে এসেছিলেন এখানে, এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, তার প্রিয় জনগণের কাছে। বঙ্গবন্ধু তার বিখ্যাত ৭ মার্চের ভাষণ এখানেই দিয়েছিলেন, ডাক দিয়েছিলেন যার যা আছে তাই নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খান ফাঁসি দিয়ে জাতির পিতাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। বিশ্বজনমতের চাপে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ ২৫-৩০ বছর আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলছিলেন তখনই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর পরই শুরু হয় হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে মুক্তি দেন, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। প্রতি রাতে কারফিউ দিয়ে দেশ চালান এবং হাজার হাজার সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারা কখনো বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাননি। কারণ তারা বাংলাদেশে অবস্থান করলেও মনেপ্রাণে ছিলেন পাকিস্তানি। পরাজিত হানাদারদের পদলেহন করেই ক্ষমতায় থেকেছেন।

প্রধানমন্ত্রী তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে রূপরেখা দিয়েছিলেন। বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে দেশকে অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশকে ঠিক সেভাবেই উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। এ সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পালন করতে চাই দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে।

 

সর্বশেষ খবর