শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

৭২ ঘণ্টায় ১৫ অভিযান

জিয়া মুসা বাসার গান্ধীসহ ডজন শীর্ষ জঙ্গি নিয়ে পুলিশের ঘুম হারাম, ছদ্মবেশে ঘুরছেন, জায়গা বদল ঘনঘন

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাখাওয়াত কাওসার

জঙ্গি ডেরায় আত্মগোপনে থাকা ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযান চলছে। রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টায় অন্তত ১৫টি অভিযান চালানো হয়। তবে অভিযানে সন্দেহজনক ওই বাসা-বাড়ি ও অফিস থেকে পুলিশের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই শীর্ষ জঙ্গিদের কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছে, দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন মরিয়া।

সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সমন্বয়ক ও সামরিক কমান্ডার চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, নব্য জেএমবির অন্যতম সংগঠক ও সুইসাইডাল স্কোয়াড প্রধান মইনুল ইসলাম ওরফে আবু মুসা, জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে শুভাষ, বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটসহ ডজনখানেক ভয়ঙ্কর জঙ্গি গোয়েন্দাদের নিশানায় রয়েছে। ভয়ঙ্কর অপর জঙ্গিরা হলো রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, ইকবাল, রিপন, খালিদ, মানিক, মামুন, জুনায়েদ খান ও আজাদুল কবিরাজ। এদের মধ্যে আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মাস্টারমাইন্ডদের চারজন রয়েছে।

ইতিমধ্যে জঙ্গি দমন অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি কানাডীয় নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী, আবুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান, নূরুল ইসলাম মারজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও তানভীর কাদেরী নিহত হয়।  জঙ্গি দমনে অভিযান সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু শীর্ষ এই জঙ্গি নেতারা লাপাত্তা হলেও তারা ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরছে। এ ছাড়া এক জায়গায় তারা বেশি দিন থাকছে না। ঘনঘন জায়গা বদল করছে। তাই তাদের পাকড়াও করতে সময় লাগছে।  ওই কর্মকর্তারা মনে করছেন, কঠোর অভিযানের কারণে শীর্ষ জঙ্গি তাদের নাশকতা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারলেও সংগঠনের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ ও তাদের ‘মগজ ধোলাইয়ে’ কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এসব ঠেকাতে তাদের যত শিগগির সম্ভব গ্রেফতারে জোর তৎপরতা চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, পলাতক জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান। দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সব জঙ্গিকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, এদের গ্রেফতার করতে পারলে জঙ্গি দমনে অনেকটাই এগিয়ে যাবে পুলিশ। এ ছাড়া পাওয়া যাবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আরও তথ্য। জঙ্গিদের লাগাম টেনে ধরা সহজ হবে। সেই চেষ্টাই করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে শিগগিরই ভালো খবর পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জঙ্গি দমনে র‌্যাবের অভিযান সব সময় চলছে। সর্বশেষ গ্রেফতারকৃত জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের ১০ জনের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদেই আমরা কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। ওইসব তথ্যের পর্যালোচনা চলছে। এর বাইরেও একাধিক উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সব অভিযানেই যে সফলতা আসবে তা কিন্তু নয়। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ জঙ্গি দমনে কাজ করা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবি এবং এবিটির কার্যক্রম ভিন্ন। এবিটি নেতা মেজর জিয়া দেশে ব্লগার ও মুক্তমনা মানুষ হত্যার অন্যতম হোতা। অপর দিকে আবু মুসা ও বাসারুজ্জামান নব্য জেএমবির মূলহোতা নিহত জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরীর আস্থাভাজন। নব্য জেএমবির টার্গেট মাজারপন্থি, শিয়া সম্প্রদায় ও বিদেশি নাগরিক। ওই কর্মকর্তা বলেন, নিশানায় থাকা এই ১২ শীর্ষ জঙ্গির মধ্যে ছয়জন দুর্ধর্ষ। এরা প্রত্যেকেই এক একটি সংগঠন পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম হোতা চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক ২০১২ সাল থেকে লাপাত্তা। জিয়া সর্বশেষ মিরপুর সেনানিবাসের পলাশ ভবনের ১২ তলায় ছিলেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আত্মগোপনে থেকে জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিশ সদর দফতর তাকে ধরিয়ে দিতে গত বছরের ২ আগস্ট ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। গতকাল দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া এবিটির জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য অনুযায়ী জিয়া দেশেই আছেন। গোয়েন্দাদের ধারণা, জিয়ার মুখে একসময় দাড়ি ছিল; এখন তিনি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে দাড়ি কামিয়ে ফেলেছেন। নানা ছদ্মবেশে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাকে গ্রেফতারে সব চেষ্টা অব্যাহত আছে। সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে অন্যতম রাজীব গান্ধী ওরফে শুভাষ ওরফে শান্ত ওরফে আদিল। নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার রাজীব গান্ধী ৩২টি জঙ্গি হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে রাজীব গান্ধী নিজ হাতে জবাই করে। নিজ দলের সদস্য ডা. নজরুলকেও গলা কেটে হত্যা করে। ৩৫ বছর বয়সী এই জঙ্গি নেতার বাড়ি গাইবান্ধায়। গুলশান হামলা চালাতে সে জঙ্গি সরবরাহ করে। তাকে ধরতেও অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আশকোনা অভিযানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কপালে নতুন করে ভাঁজ সৃষ্টি করে সুইসাইডাল স্কোয়াড প্রধান মইনুল ইসলাম ওরফে আবু মুসা। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ২৩ ডিসেম্বর আশকোনায় মুসার আস্তানায় অভিযান চালানো হলে তার স্ত্রী তৃষামনি ওরফে উম্মে আয়েশা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সে পুলিশকে জানিয়েছে, সুসাইডাল স্কোয়াডের পুরো তত্ত্বাবধানকারী হলো মুসা। অস্ত্র চালনা এবং বোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত এই ভয়ঙ্কর মুসা সংগঠিত করছে নব্য জেএমবির অন্য সদস্যদের। রাজধানীতেই রয়েছে তার বেশ কয়েকটি সুইসাইডাল জঙ্গি আস্তানা। এসব আস্তানা কোন কোন এলাকায় তা নিশ্চিত হলেও সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। পলাতক মুসাই এখন নব্য জেএমবিকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, মারজান জীবিত থাকার সময়ে তার নির্দেশেই দায়িত্ব পালন করত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেট। সংগঠনে নানা যোগাযোগ তদারকের পাশাপাশি গুলশান হামলার আগে নব্য জেএমবির কাছে বিদেশ থেকে আসা টাকা গ্রহণ ও বণ্টন করেছিল সে। অস্ত্র সংগ্রহেও ছিল তার ভূমিকা। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, মারজান নিহত হওয়ায় চকলেটকে এসব দায়িত্ব এখন একাই পালন করতে হবে। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, স্ত্রী ফেরদৌসী আফরিনকে নিয়ে বাসারুজ্জামান আমেরিকায় রয়েছে বলে স্বজনরা জানালেও গত সেপ্টেম্বরে আজিমপুরের আস্তানা থেকে তার স্ত্রীকে গ্রেফতারের পরই বেরিয়ে আসে আসল ব্যাপার। জানা যায়, ওই দম্পতি দেশে থেকেই জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। নতুন জঙ্গিদের মগজ ধোলাইয়ের কাজ করছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত সংগঠনের আইটি-বিষয়ক কাজগুলোও তদারক করে বাসারুজ্জামান।

সর্বশেষ খবর