স্বাস্থ্যসেবায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা কাটাতে সরকারকেই উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার মতে, ‘চিকিত্সা খাতে এখনো হাজারো সমস্যা। সরকার এখনো ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেকাংশে বিশৃঙ্খলা কেটে যাবে। জেনেটিকের দিকে না গিয়ে চিকিত্সকরাও প্রেসক্রিপশনে বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছেন। রোগীরা এতে প্রতারিত হচ্ছেন। ভুল ওষুধ সেবনের কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারাও যাচ্ছেন। এজন্য আমি মনে করি, ’৮২ সালের ওষুধনীতি কার্যকর করা জরুরি।’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন ডা. জাফরুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘১৯৮২ সালে একটি জাতীয় ওষুধনীতি করা হয়েছিল। আমি মনে করি, ওই নীতি পৃথিবীর একটি অনন্য উদাহরণ। সেখানে ওষুধের দাম নির্ধারণ হয়েছিল। সহজলভ্যতা ও প্রাপ্ততা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গুণগত মানও তুলে ধরা হয়।’ দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন উন্নতি হয়নি মেডিকেলে পড়াশোনার। এখনো বাংলাদেশের চিকিত্সকরা বোঝেন না, ওষুধের দাম বেশি হওয়ার কারণ কি? কোনো মেডিকেল কলেজে শেখানো হয় না—ওষুধ কি করে বানানো হয়, খরচ কত। এটা না হওয়ার কারণে চিকিত্সকরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। জেনেটিক ওষুধের দিকে যাচ্ছেন না।’
ডা. জাফরুল্লাহর মতে, ‘রোগীদের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। এতে নকল ওষুধের সংখ্যাও বাড়ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। কম দামি ওষুধ কখনো নকল হয় না। বেশি দামি ওষুধই নকল হচ্ছে। বেশি দাম মানেই বেশি লাভ করার প্রবণতা। যে ওষধ তৈরি করতে খরচ হয় কম, তার দাম ধরা হয় বেশি। মূলত কোনো ওষধই তৈরিতে খুব একটা খরচ হয় না। কিন্তু সেটা বিক্রি হয়, ৫-৭ গুণ বেশি দামে। একগুণ খরচ করে ৬ গুণ লাভ করার প্রবণতার কারণেই সেটা নকল করা হচ্ছে। আটা ময়দা দিয়েও এখন ওষুধ বানানো হয়। এতে বেশি দাম দিয়ে কিনেও গ্রাহকরা উপকারিতা পাচ্ছেন না। এটা বন্ধ করা জরুরি। এ নিয়ে আগে বদনাম ছিল নাইজেরিয়া, মেক্সিকো ও ইন্ডিয়ায়। এখন সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশও।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ হাসপাতাল ব্যবস্থাও খারাপ। ওয়ার্ডে চিকিত্সা না করে কথায় কথায় আইসিওতে নেওয়া হয়। একটা আইসিওতে দৈনিক খরচ ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। সোনারগাঁ বা ফাইভস্টার হোটেলে থাকতেও এত খরচ হয় না। এখানেও হয় হরেক রকম প্রতারণা। নানা সার্ভিস চার্জে দিশাহারা হয় রোগীর পরিবার। এজন্য সরকারকেই আইসিও রুমের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। সার্ভিস চার্জের নামে নানা ধরনের ফি নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।’তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে রোগী মারা যাচ্ছে। সেটা কি চিকিত্সকের কারণে মারা গেছে না অন্য কারণে মারা গেছে, তাও শনাক্ত করা হয় না। অন্যান্য দেশে নিয়ম আছে, ডেথ অডিট। মৃত্যুর কারণ পরীক্ষা করা হয়। প্রেসক্রিপশন ও চিকিত্সা সেবা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু এখানে তা করা হয় না। বাংলাদেশে হাসপাতালে রোগীকে অকারণেই ধরে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এখানে ৬০ ভাগেরও বেশি সিজারিয়ান অপারেশন করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এটা ২০ ভাগের নিচে হওয়া উচিত। এখানেও রোগীরা প্রতারণার শিকার হন।’
সম্প্রতি প্রেসক্রিপশনের ওপর হাইকোর্টে একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে বলে জানান ডা. জাফরুল্লাহ। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট বিচারক ও রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদকে ধন্যবাদ দেন। এই চিকিত্সক বলেন, ‘এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। চিকিত্সকের হাতের লেখার অস্পষ্টতা ও ভুলের কারণে অনেক জটিল সমস্যা হচ্ছে। ভুল ওষুধ সেবনের কারণে অনেকে মারাও যাচ্ছেন। একটি ওষুধ প্যারাসিটামল। কিন্তু চিকিত্সকরা এই জেনেটিক ওষধের দিকে না গিয়ে ডাফা, সাফা, নাপাসহ হরেক রকমের ওষুধ কোম্পানির ব্র্যান্ডের নাম লিখে দিচ্ছেন। এটাও আমাদের পরিহার করতে হবে। ’৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও এটা বলা হয়েছে, ওষুধের জেনেটিক নামকে প্রাধান্য দিতে হবে। ব্র্যান্ডের নাম থাকতে পারে তবে যে পাশে নাপা লেখা হবে সেই সমপরিমাণ লেখতে হবে প্যারাসিটামল। তাহলে বুঝতে পারবে, প্যারাসিটামল আর নাপা একই জিনিস।’
তিনি বলেন, ‘প্যারাসিটামল খেলে আমাদের কারও অসুবিধা হয়, তাহলে চিকিত্সককে গিয়ে অভিযোগ করা যাবে। এজন্যই জেনেটিক লেখার কথা বলা হয়েছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক নাম প্রচার করে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। এতে জনসাধারণের ক্ষতি হতে পারে। তারা কি ওষুধ খাচ্ছে বুঝতে পারে না। এজন্য জেনেটিক নাম গুরুত্বপূর্ণ।’
চিকিত্সা সেবায় প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের প্রশংসাও করেন তিনি। ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা দেওয়া, ডায়রিয়ার চিকিত্সা করা, পরিবার পরিকল্পনার কাজ করছেন। গর্ভবতী হলে তার সেবা দিচ্ছেন। এতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দেশকে একটি উল্লেখ করার মতো স্থানে নিয়ে গেছে মহিলা স্থাস্থ্যকর্মীরা। এর মূল পরিকল্পনা দিয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ১৯৭৭ সালে কাজাকিস্তানের রাজধানী আলমা আতায় ১৩৬টি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই ছিলেন। সেখানে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে উদাহরণ হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তুলে ধরা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৩৭ বছর। এখন হয়েছে ৭০ বছর। এর মূল কৃতিত্ব হলো গ্রামের সাধারণ মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের। এদের কারণে আজ শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। তারা পরিবার-পরিকল্পনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। এখানে চিকিত্সকের অবদান খুবই কম। চিকিত্সকদের একটি মাত্র অবদানই আছে, তারা এসব মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। একজন ডাক্তার কয়েকশ’ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সেকেন্ডারি হেলথ কেয়ারেও চলছে প্রতারণা। অপারেশন বা ভর্তি সব ক্ষেত্রেই এটা হচ্ছে। এখানে জনসাধারণকে সচেতন করা হয় না। এখানে সহজেই সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়। প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের কাছে সব ওষুধই কিনতে পাওয়া যায়। সব দেশেই নিয়ম হলো ওষুধ যেহেতু বিশেষ কেমিকেল, তাই চিকিত্সকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা উচিত নয়।
সরকারকে শুধু চিকিত্সকদের পেছনে না ঘুরে রক্তসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য টেকনিশিয়ানের দিকে নজর বেশি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তার মতে, ‘এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও সরকারকে নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।’