শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাত খুনে ২৬ ফাঁসি

সাখাওয়াত কাওসার, রোমান চৌধুরী সুমন ও এম এ শাহীন, নারায়ণগঞ্জ থেকে

সাত খুনে ২৬ ফাঁসি

রায়ের পর গতকাল আদালত প্রাঙ্গণে নূর হোসেন (বাঁয়ে)। তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, প্রিজন ভ্যানে তোলার পর জ্যাকেট পরে বসেন (মাঝে)। আরিফ ও রানা প্রিজন ভ্যানে —রোহেত রাজীব

বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় র‌্যাব-১১-এর সাবেক তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে ৩৫ আসামির বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। নৃশংস, রোমহর্ষক ওই ঘটনার ২ বছর ৮ মাস ১৯ দিন পর এ রায় ঘোষিত হলো। রায় ঘোষণার সময় ৩৫ আসামির মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই র‌্যাবের সাবেক সদস্য। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত র‌্যাব-১১-এর সাবেক সদস্যরা হলেন চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ  মুহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকিরা হলেন সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, তার সহযোগী মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান (চার্চিল), সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। এর মধ্যে সেলিম, সানাউল্লাহ ও শাহজাহান পলাতক। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ৯ জনও র‌্যাবের বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তা ও সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল হাবিবুর রহমানকে ১৭ বছর; এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, করপোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহি নুরুজ্জামানকে ১০ বছর এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত।

দণ্ডপ্রাপ্ত ৩৫ আসামির মধ্যে নূর হোসেনসহ ২৩ জন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রায় শোনেন। বাকি ১২ আসামি পলাতক।

ঠিক ১০টায় এজলাসে প্রবেশ করেন জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। এর পরই পেশকার মো. শাহাবুদ্দীন নাম ডেকে মামলার আসামিদের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ সময় উপস্থিত ২৩ আসামি হাত তুলে তাদের উপস্থিতির বিষয়টি আদালতকে নিশ্চিত করেন। সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন জেলা ও দায়রা জজ। সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলাকে একটি হিসেবে গ্রহণ করে রায় দেয় আদালত। সংক্ষিপ্ত রায়ে শুধু আসামিদের সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে বলে জানান বিচারক। রায় ঘোষণার পরপরই তিনজন আসামি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এর মধ্যে সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা মাসুদ রানাও ছিলেন। এ সময় তাকে সান্ত্বনা দেন অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী নূর হোসেন। আদালতে অবস্থানের প্রায় পুরো সময়ই ভাবলেশহীন ছিলেন তিনি। লোহার খাঁচায় থেকেও দীর্ঘ সময় ধরে নূর হোসেন কথা বলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত র‌্যাবের সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদের সঙ্গে। নূর হোসেনকে বেশ কয়েক দফা হাসতেও দেখা গেছে। এর আগে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে গ্রেফতার ২৩ আসামিকে আদালতের হাজতখানা থেকে কাঠগড়ার লোহার খাঁচায় এনে রাখা হয়। ১০টায় এজলাসকক্ষে আসন নেন বিচারক। আর ১০টা ৫ মিনিটেই সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের মধ্যে ১৮ জনকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে এবং নূর হোসেনসহ ৫ জনকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ থেকে আদালতে নেওয়া হয়। এদিকে, আসামিদের সাজার বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন। এর আগে সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলার বিচারিক কার্যক্রম একসঙ্গে শেষ করে আদালত। একটি মামলার বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল এবং অন্যটির বাদী নিহত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে নাসিক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণের তিন দিন পর তাদের লাশ শীতলক্ষ্ম্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। নিহত অন্যরা হলেন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম। সাত খুনের ঘটনায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার ৪ সহকর্মী হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় নিহত আইনজীবীর জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা করেন। দীর্ঘ প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সাত খুনের দুটি মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত। র‌্যাবের ৮ সদস্যসহ পলাতক ১২ আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। তবে পলাতক ১২ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে ৫ জন আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুটি মামলারই অভিন্ন সাক্ষী ১২৭ জন করে। তাদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১০৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে আদালত। মামলার সর্বশেষ ধাপ উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে গত বছরের ৩০ নভেম্বর রায়ের জন্য ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭-কে তারিখ হিসেবে ধার্য করে আদালত।

হ্যান্ডকাফ-ডাণ্ডাবেড়ি ছিল না : আদালতে সব আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি ও হ্যান্ডকাফ পরানোর নিয়ম থাকলেও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তার কাউকেই ডাণ্ডাবেড়ি, হ্যান্ডকাফ কিংবা রশি পরানো হয়নি। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পরও তাদের এ নিয়মের বাইরে রাখা হয়। আদালতে পুরো সময়ই তারা খোশ মেজাজে ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর ৩৭। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয় : সার্বিক নিরাপত্তার জন্যই সব আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি, হ্যান্ডকাফ এবং রশি পরিয়ে আদালতে আনা দরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ওই বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছিল। তবে রহস্যজনক কারণে কারা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি মান্য করেনি। জানা গেছে, ডাণ্ডাবেড়ির বিষয়টি সব সময়ই কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে। হ্যান্ডকাফ ও রশি নিশ্চিত করে জেলা পুলিশ। কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামিদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রথম এবং শেষ পর্যায়ে গাজীপুর জেলা পুলিশের। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মইনুল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে আসামি আনা হলে তার হ্যান্ডকাফ ও রশির বিষয়টি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’ এ বিষয়ে কারা উপমহাপরিদর্শক তৌহিদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি বলে তিনি লাইন কেটে দেন।

কড়া নিরাপত্তা : বহুল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা কেন্দ্র করে দুই দিন ধরেই নারায়ণগঞ্জসহ এর আশপাশ এলাকায় কড়া নিরাপত্তা গ্রহণ করে প্রশাসন। টানা দুই দিন ধরেই নারায়ণগঞ্জের মোড়ে মোড়ে ছিলেন পোশাকে ও সাদা পোশাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। বিশেষ করে গতকাল আসামিদের আনা-নেওয়ার সময় বিভিন্ন উঁচু ভবনের ছাদে অবস্থান নেন র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা।

সর্বশেষ খবর