শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেদিন যেভাবে ৭ জনকে খুন করা হয়েছিল

সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রায় তিন বছর আগে সাত খুনের নৃশংস ঘটনাটি শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছিল। সাতজনকে হত্যা করা হয়েছিল নারকীয় নৃশংসতায়। একই স্টাইলে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেওয়া হয় প্রত্যেককে। লাশ যেন ভেসে না ওঠে সেজন্য বেঁধে দেওয়া হয় ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ। কেটে দেওয়া হয় পেট। কিন্তু এতেও রক্ষা হয়নি। লাশগুলো ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যায়। সাত খুনের ঘটনায় আদালতে আসামি ও  সাক্ষীদের জবানিতে বেরিয়ে আসে সেদিনের নৃশংসতার রোমহর্ষক বর্ণনা। চার্জশিট, জবানবন্দি, মামলার নথি ও সুরতহাল রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক)-এর কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কারণ তারা জানতেন যে, নূর হোসেনের এক নিকটআত্মীয় মোবাররক হোসেনের দায়ের করা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি চাঁদাবাজির মামলায় স্থায়ী জামিনের জন্য নজরুল ইসলাম আদালতে যাবেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল যথারীতি নজরুল ইসলাম আদালতে যান। নিরাপত্তাজনিত কারণে এদিন তিনি নিজের গাড়ি না এনে তার ব্যবসায়ী পার্টনার মনিরুজ্জামান স্বপনের সাদা রঙের এক্স করোলা গাড়ি ব্যবহার করেন। র‌্যাবের তৎকালীন কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন নজরুলের অবস্থান নিশ্চিত হয়েই সেদিন সকালে অপহরণ পার্টিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করিয়ে রাখেন। সাদা পোশাকের একটি টিম নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয়। তারা সার্বক্ষণিক মেজর আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অন্তরবর্তীকালীন জামিন নিয়ে আদালত থেকে গাড়িতে করে নজরুল ইসলাম বের হন। মেজর আরিফের কাছে খবর পৌঁছে যায়। আদালতের আশপাশে অবস্থান নেওয়া সাদা পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা প্রস্তুত। নজরুলের সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন ব্যবসায়ী পার্টনার ও সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম। গাড়ি চালাচ্ছিলেন স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর হোসেন। নজরুলদের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। নজরুলদের বহনকারী গাড়িটি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড হয়ে উত্তর দিকে যাওয়ার পথে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সামনে (ময়লা ফেলার স্থান) পৌঁছার পর মেজর আরিফের নেতৃত্বে গাড়ির গতিরোধ করা হয়। নজরুলের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। পরে দুটি গাড়ি থেকে সাতজনকে অস্ত্র দেখিয়ে র‌্যাবের দুটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, গাড়িতে তাদের উঠানোর পর একে একে প্রত্যেকের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করা হয়। অচেতন হওয়া সাতজনকে কয়েক ঘণ্টা তাদের গাড়িতেই রাখা হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিকল্পনা মতে কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম পাড়ে কাঁচপুর ল্যান্ডিং স্টেশনের পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথর ব্যবসাস্থল জনমানুষ শূন্য করার জন্য নূর হোসেনকে ফোন করে নির্দেশ দেন মেজর আরিফ হোসেন। সবুজ সংকেত পাওয়ার পর র‌্যাবের গাড়ি ওই স্থানে পৌঁছায়। গাড়ির ভিতরই অচেতন প্রত্যেকের মাথা ও মুখ পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়। পরে গলা চেপে একে একে সাতজনকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়। সাতজনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামানো হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫ নম্বর ঘাট থেকে র‌্যাবের নির্দিষ্ট নৌকা নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর সেতুর নিচে। লাশগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে যাওয়ার পথে ‘নির্দিষ্ট স্থান’ থেকে লাশ গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। নৌকার মধ্যেই সাতজনের পায়ে ২৪টি করে ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর হাত পেছন করে রশি দিয়ে বাঁধা হয়। মুখমণ্ডল ডাবল পলিথিন দিয়ে গলার কাছে বাঁধা হয়। পেট কেটে দেওয়া হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে। এভাবেই সাতজনের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। পরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকা সংলগ্ন নদীতে কয়েকটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। এরপর ৩০ এপ্রিল বিকালে পুলিশ গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর এক কিলোমিটারের মতো এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে একে একে ছয়টি লাশ তুলে উদ্ধার করে। এরপর ১ মে সকালে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সাত খুন মামলা পরিচালনা করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মাত্র আট মাসেই মামলার আইনি কার্যক্রম শেষ হয়। ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। যুক্তিতর্ক ও আসামিদের জেরাতে রাষ্ট্রপক্ষ তথা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, মামলায় অভিযুক্তরা সবাই সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা, গুমসহ পুরো কার্যক্রমে জড়িত।’ গতকাল নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। বাকি ৯ জনকে সাত থেকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে তিনজন পলাতক।

সর্বশেষ খবর