মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

চার মিনিটের রায়

সাখাওয়াত কাওসার

কাক ডাকা ভোর থেকেই বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের আদালত পাড়ায় কড়া নিরাপত্তা। চাঁদমারী এলাকায় নতুন কোর্টে কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী এবং বাদী-বিবাদীর স্বজনদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ের কারণে আদালতের অন্যসব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে এটা আদালত সংশ্লিষ্টদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। সবার মনেই একটা প্রশ্ন কী রায় হবে সাত খুনের? একে অপরের সঙ্গে শুধু এই কানাকানি-ফিসফিস। সকাল ৯টার কিছু পর একে একে প্রিজন ভ্যানে করে আসামিদের আদালতে আনা হয়। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তিনটি প্রিজন ভ্যানে করে আনা হয় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা এবং নূর হোসেনকে। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত এবং বাইরে অপেক্ষমাণ অগণিত মানুষ বলাবলি করছিলেন, এখন খুব বেশি সময় লাগবে না। হয়তো ১১টার দিকে রায় ঘোষণা হয়ে যেতে পারে! তবে সবাইকে অবাক করে দিলেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। আদালতের দেয়াল ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক ৯টা ৫৮ মিনিটে অবস্থান করছে। এ সময় এক বার্তা বাহক পেছনের কক্ষ থেকে এজলাসে এসে জানান দিলেন ‘স্যার’ (বিচারক) আসছেন। মুহূর্তেই পিনপতন নীরবতা জেলা দায়রা জজ আদালতে। ঘড়ির কাঁটা যখন ১০টায় তখনই এজলাসে আসেন সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। শুরু হয় আদালতের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। যদিও এর আগে আদালতের কাঠগড়ায় এবং লোহার খাঁচায় এনে রাখা হয়েছিল ২৩ জন আসামিকে। তবে শুরু থেকে নির্বিকার ছিলেন র‌্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা। ভাবলেশহীন ছিলেন নূর হোসেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) মো. শাহাবুদ্দীন একে একে নাম ডেকে মামলার আসামিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। কেউ মাথা নেড়ে আবার কেউ হাত তুলে ২৩ জন আসামি তাদের উপস্থিতির বিষয়টি আদালতকে নিশ্চিত করেন। এরই মধ্যে কেটে যায় ৫ মিনিট। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১০টা ৫ মিনিট। শুরু হয় মূল রায় পড়া। সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালত সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলাকে একটি হিসেবে গ্রহণ করে রায় দেন। আদালত বলে, অভিন্ন দুটি মামলার সাজা একই রকম। ঘোষণা আসে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসির। বাকি নয়জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। আদালত বলে, সংক্ষিপ্ত রায়ে শুধু আসামিদের সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। রায় ঘোষণার পরপরই তিনজন আসামি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এর মধ্যে সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা মাসুদ রানাও ছিলেন। এ সময় তাকে সান্ত্ব্বনা দিতে দেখা যায় সাত খুনের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী নূর হোসেনকে। সকাল ১০টা ৯ মিনিটে রায় পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে আদালত ত্যাগ করেন বিচারক। পরবর্তীতে আদালত থেকে একে একে আসামিদের পুনরায় প্রিজন ভ্যানে নিয়ে রাখেন পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে সবশেষে প্রিজন ভ্যানে নেওয়া হয় নূর হোসেনকে।  অন্যদিকে, রায় ঘোষণার পর পরই নূর হোসেন খাঁচার ফাঁক গলে এগিয়ে কথা বললেন তারেক সাঈদের সঙ্গে। কী যেন কথা শেষে কান্নারত অন্য আসামিদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন নূর হোসেন। কারও মাথায় কিংবা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। আবার খাঁচায় থাকা অবস্থায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলতে দেখা গেছে নূর হোসেনকে। পুরো সময়েই নূর হোসেনকে স্বাভাবিক দেখা গেছে। আদালত থেকে পুনরায় প্রিজন ভ্যানে নেওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নূর হোসেন কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। রায় ঘোষণা শেষে প্রিজন ভ্যানে নেওয়ার সময় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি মোখলেসুর রহমান গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একপর্যায়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মারতে উদ্যত হন তিনি। চিৎকার করে তিনি বলতে থাকেন, ‘সাংবাদিকগো লাইগ্যাই আমাগো এই অবস্থা।’ সর্বশেষ বিকালে আসামিদের নিয়ে যাওয়ার পর আদালতের বাইরে শত শত উত্সুক জনতার ভিড় দেখা যায়। ফাঁসির রায় কার্যকর চেয়ে মিছিলও করেন নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা।

সর্বশেষ খবর