বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হচ্ছেটা কী

জুলকার নাইন

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হচ্ছেটা কী

ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শফিউল আজম মিলন গত বছরের মাঝামাঝি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। প্রয়োজন হয় বাইপাস সার্জারির। স্বল্প আয়ের মিলনের জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালই ভরসা। গত ৩১ আগস্ট তার অপারেশন হয়। তার অপারেশনের পদ্ধতিটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘অফপাম সিএবিজি’ বলা হয়। টাকা নেওয়া হয় ‘অক্সিজেনারেটর’ ও ‘শান্ট’ কিনতে। এই দুই যন্ত্র বাবদ ৬০ হাজার টাকা নিশ্চিত করার পরই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অক্সিজেনারেটরের জন্য ২৫-৩০ হাজার এবং তিনটি ‘শান্টে’র জন্য ২১-২৫ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে রোগীকে জানানো হয়। কিন্তু যে পদ্ধতিতে শফিউলের অপারেশন করা হয়েছে, সেই ‘অফপাম সিএবিজি’-তে অক্সিজেনারেটর নামক মেশিনের ব্যবহারই হয় না। তারপরও শফিউলের মতো প্রত্যেক ‘অফপাম সিএবিজি’র রোগীকে দিয়ে অক্সিজেনারেটর মেশিন কিনিয়ে নিচ্ছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের গুটি কয়েক ডাক্তারের একটি বিশেষ সিন্ডিকেট। রোগীকে দিয়ে নতুন মেশিন কিনে আবার কোম্পানিতে বিক্রি হচ্ছে। পকেটে টাকা নিয়ে নিচ্ছেন তিন চিকিৎসকের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট। শান্ট কেনার ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের ব্যবসা রমরমা। যেখানে একটি শান্ট দিয়ে সাধারণত ৫০-৬০টি (না ছেঁড়া পর্যন্ত) অপারেশন করা সম্ভব সেখানে প্রত্যেক  রোগীকে দিয়ে তিনটি করে শান্ট কেনানো হচ্ছে। প্রত্যেক অপারেশনেই পকেটে যাচ্ছে আরও ২১-২৫ হাজার টাকা। আর সরকারি হাসপাতালে অপারেশনের দীর্ঘ লাইনে আছেন রোগীরা। প্রত্যেকের কষ্টের ৫০-৬০ হাজার টাকা হাসপাতাল থেকে লুটে নিচ্ছে মাত্র কয়েকজন। এদের মধ্যে একজন ক্ষমতাসীন দলের চিকিৎসক নেতা হওয়ায় হাসপাতালের অন্য কেউ কথা বলার সাহসও পাচ্ছেন না। বরং সিন্ডিকেটের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বেশিরভাগেরাই। অপারেশনে না লাগলেও ‘অক্সিজেনারেটর’ ও ‘শান্ট’ কেনার নামে টাকা নেওয়া কীভাবে সম্ভব জানতে চাইল জটিল বাইপাস অপারেশনের সহজ ব্যাখ্যা দিলেন হৃদরোগের বিশ্বস্ত সার্জন অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে যখন বাইপাস সার্জারির যে দুটি পদ্ধতি ছিল তার একটি পুরনো, একটি আধুনিক। আগে রোগীর সব রক্ত বাইরে এনে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বন্ধ করে অপারেশন করা হতো। এতে আলাদা আলাদা মেশিনের প্রয়োজন হতো, চিকিৎসার খরচ বেড়ে যেত এবং রোগীর জীবনও পড়ত ঝুঁকিতে। তখন রোগীর রক্ত দেহের বাইরে রাখতে ‘অক্সিজেনারেটর’ নামের মেশিনের ব্যবহার হতো। এখন হৃদযন্ত্র চালু রেখেই অপারেশন করা হয়। তাই রক্তও বাইরে আনা হয় না। এটাই ‘অফপাম সিএবিজি’। এ ক্ষেত্রে আলাদা করে প্রত্যেক অপারেশনে অক্সিজেনারেটরের জন্য টাকা নেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। অপারেশন থিয়েটারের ব্যাকআপই যথেষ্ট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রোগীদের ‘অফপাম সিএবিজি’ অপারেশনের জন্য কেনা এসব নতুন নতুন ‘অক্সিজেনারেটর’ ও ‘শান্ট’র প্যাকেট খোলাই হচ্ছে না। প্যাকেট ভর্তি এসব বাক্স রোগী টাকা দিয়ে কেনার পর সিন্ডিকেটের চিকিৎসকদের সহকারীরা নিজেদের জিম্মায় নিচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে আবার ফেরত যাচ্ছে বিক্রয়কারী কোম্পানির লোকের হাতে। বিনিময়ে কোম্পানি অপারেশন প্রতি ৫০-৬০ হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছে অ্যাকাউন্টে। সপ্তাহান্তে টাকা চলে যাচ্ছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের তিন ইউনিট প্রধানের কাছে। তাদের সিন্ডিকেটের হয়েই কাজ করছে এই দুই যন্ত্র সরবরাহকারী চার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও।

সূত্র মতে, সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কামরুল হাসান মিলন এবং অন্য দুই ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ডা. মঞ্জুরুল আলম ও অধ্যাপক ডা. রামপদ সরকার। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে এই তিনজনই শুধু ‘অফপাম সিএবিজি’ পদ্ধতিতে অপারেশন করে থাকেন। এরমধ্যে ডা. কামরুল হাসান মিলন স্বাচিপের প্রভাবশালী নেতা এবং বর্তমানে বিএমএ’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বিভাগে সিনিয়রদের বয়োকনিষ্ঠ হওয়ার পরও তিনি বিভাগীয় প্রধান। এখন তার ব্যস্ততা ধানমন্ডিতে একটি সি ফুড রেস্টুরেন্টের স্বপ্ন পূরণ নিয়ে। গতকালও হাসপাতালে দেখা গেল, অপারেশনের অপেক্ষায় থাকা দুই রোগী ইতিমধ্যেই ‘অক্সিজেনারেটর’ ও ‘শান্ট’ কিনেছেন। বিক্রেতা কোম্পানির প্রতিনিধিরা হাসপাতালের বেডে এসে যন্ত্রাদি বিক্রি করেছেন। সংরক্ষণের জন্য চিকিৎসককে তত্ত্বাবধায়কের কাছে সেগুলো রাখা হয়েছে। সূত্র মতে, ‘অক্সিজেনারেটর’ ও ‘শান্ট’ বিক্রির জন্য চারটি কোম্পানিকেই ঘুরেফিরে সুযোগ দেন তিন চিকিৎসক। এর মধ্যে আছে ইউনিমেইড, স্পন্দন, ভিশন মেডিটেক ও বায়োমেট নামের কোম্পানি।

সম্প্রতি অপারেশন করা উত্তরাঞ্চলের একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ জানালেন, ‘কোন রোগী কোন কোম্পানির কাছ থেকে যন্ত্রাদি কিনবেন তা ঠিক করে দেন তিন চিকিৎসকই। ওষুধ কেনার দোকানও ঠিক হয় রোগীর নিজ নিজ চিকিৎসকের মাধ্যমে। এ ছাড়া অপারেশন হবে না। আর হৃদযন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের ক্ষেত্রে রোগীও চিকিৎসকের অবাধ্য হন না। তাই সিন্ডিকেটের ব্যবসাও কখনো কমে না।’

হাসপাতালে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আবাসিক সার্জন ডা. আশরাফ সিয়াম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় স্বল্প খরচ নিশ্চিত করাই হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য। মেশিন ব্যবহার না করেও টাকা নেওয়ার তথ্য আমার জানা নেই।’ গত দুই দিন চেষ্টা করেও ডা. কামরুল হাসান মিলনের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও পেশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যন্ত্র ব্যবহার না করে রোগীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করা অপরাধের শামিল। আর রোগীদের কাছ থেকে যে চিকিৎসকরা এই অর্থ আদায় করছে তারা অপরাধ করছে। রোগীদের ঠকাচ্ছে। সাধারণত সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসকরা চিকিৎসার জন্য আসেন তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই অসচ্ছল হন। আর দরিদ্র এই রোগীদের অসচেতনতার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা গরিব রোগীদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।’

সর্বশেষ খবর