বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফাঁসির আসামিরা কে কোথায়

নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন

সাখাওয়াত কাওসার ও এম এ শাহীন

বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় গ্রেফতার র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ১৭ ফাঁসির আসামির ঠাঁই হয়েছে কারাগারের কনডেম সেলে। গতকালই তাদের কাশিমপুর পার্ট-১, পার্ট-২ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের কনডেম সেলে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে টুপিসহ সাদা-কালো ডোরাকাটা নতুন পোশাক। তবে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ জন এবং বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত আরও ৩ জনকে গ্রেফতারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে পলাতকদের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন তথ্যেরও যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানিয়েছেন তারা।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মইনুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পলাতকদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এখন পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্যই আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ পলাতকদের ব্যাপারে কোনো তথ্য থাকলে তা দিয়ে সহায়তা করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান তিনি। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পলাতক রয়েছেন র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন এমন ৮ জনসহ নূর হোসেনঘনিষ্ঠ ৪ সহযোগী। এর মধ্যে নূরের প্রধান সহযোগী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মো. সেলিম ভারতের কারাগারে বন্দী। বাকি তিন সহযোগীর মধ্যে সানাউল্লাহ সানা ও নূর হোসেনের ম্যানেজার শাহজাহান শুরুর দিকে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গেলেও বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রয়েছে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ। দেশ থেকে পরিবারের সদস্যরা তাদের জন্য নিয়মিত অর্থ পাঠাচ্ছেন। নূর হোসেনের অন্যতম সহযোগী জামাল উদ্দীনও পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপন করে আছেন বলে এলাকায় চাউর। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক র‌্যাব সদস্য জামাল উদ্দিন, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন শরীফ, তাজুল ইসলাম ও আবদুল আলিম পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া পলাতক আসামি করপোরাল মোখলেছুর রহমান, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান ও এএসআই কামাল হোসেনেরও কারাদণ্ডের রয়ে এসেছে আদালতে। তবে গতকাল পর্যন্ত তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেননি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৬ জনের মধ্যে এলিট ফোর্স র‌্যাবের সাবেক ১৬ কর্মকর্তা ও সদস্য রয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ পলাতকের মধ্যেও র‌্যাবের সাবেক ৫ সদস্য রয়েছেন। ১০ ও ৭ বছর মেয়াদি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৩ জন পলাতক আসামি রয়েছেন। সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতে রায় ঘোষণার সময় ২৩ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এর মধ্যে ১৭ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। বাকি ৬ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদি কারাদণ্ড। কারাসূত্র বলছে, রায় ঘোষণার পর সব আসামিকেই নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ ও পার্ট-২-তে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ জনকে কাশিমপুর পার্ট-১ ও পার্ট-২ এবং ১২ জনের ঠাঁই হয়েছে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে। রায় ঘোষণার আগ থেকেই কাশিমপুর-২ কারাগারে ছিলেন র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, নূর হোসেন ও ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন। রায় ঘোষণার পর বিকালে পুনরায় কারাগারে নেওয়ার পরই তাদের ঠাঁই হয় কনডেম সেলে। এ কারাগারের ৪০ সেলে (কনডেম সেল) গতকাল পর্যন্ত ১২০ জন বন্দী রয়েছেন। সাত খুন মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি র‌্যাবের সাবেক সিও তারেক সাঈদ মুহাম্মদকে একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। অন্য একটি কক্ষে রাখা হয়েছে নূর হোসেন ও বেলাল হোসেনকে। নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের ১৫ সেলে (কনডেম) রাখা হয়েছে ১২ আসামিকে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে এসআই পূর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার এমদাদুল হক, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব, আসাদুজ্জামান নূর, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশারকে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে রাখা হয়েছে। এদের ৭ জন সাবেক র‌্যাব সদস?্য, বাকিরা সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি নূর হোসেনের সহযোগী। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কনস্টেবল বাবুল হাসান, করপোরাল রুহুল আমিন, সৈনিক নুরুজ্জামান, আবুল কালাম আজাদ, এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনও আছেন এই কারাগারে। সাবেক এসআই পূর্ণেন্দু বালা ও সাবেক এএসআই বজলুর রহমান সারা দিনই কান্নাকাটি করেছেন। রায় ঘোষণার পর থেকে তারা খাওয়া-দাওয়া অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

কাশিমপুর-১ কারাগারের কনডেম সেলের পৃথক দুটি কক্ষে রাখা হয়েছে মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (বরখাস্ত) মাসুদ রানাকে। কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির আসামিকে গতকালই টুপিসহ সাদা-কালো ডোরাকাটা নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিধি অনুযায়ী সব সুবিধাই নিশ্চিত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এর সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্তকুমার বণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার কারাগারে ৩ জন ফাঁসির আসামি রয়েছেন। তাদের শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক। নিয়মিত খাবার খাচ্ছেন তারা।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা গতকাল তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন জানিয়ে জেল সুপার আসাদুর রহমান জানান, সাত খুন মামলার সব কয়েদিই স্বাভাবিক ও সুস্থ রয়েছেন। তার কারাগারে ফাঁসির আসামিদের সেল রয়েছে ১৫টি। জায়গা না থাকায় সাত খুন মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামিকে আলাদা সেলে রাখা যায়নি। এক সেলে রাখা হয়েছে ৩ জন করে।

আসাদুর রহমান বলেন, সোমবার কনডেম সেলে নেওয়ার পর ফাঁসির আসামিদের রাতে সবজি, ডাল, ভাত ও মাছ খেতে দেওয়া হয়। গতকাল সকালে দেওয়া হয় রুটি আর গুড়। তারা তা খেয়েছেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের পর হত?্যা করে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ?্যা নদীতে। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন সোমবার এ মামলার রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ১১ জন সেনাবাহিনী, ২ জন নৌবাহিনী, ৩ জন বিজিবি, ৭ জন পুলিশ ও ২ জন আনসার থেকে র?্যাবে যোগ দেন। অপরাধ সংঘটনের সময় তারা সবাই র‌্যাব-১১-তে কর্মরত ছিলেন। সাত খুনের মামলার পর তাদের নিজ নিজ বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জেলার নাসির আহমেদ জানান, কারাগারে পৌঁছানোর পরপরই মৃত্যুদণ্ডের ৫ আসামিকে সাদা-কালো ডোরাকাটা বন্দীর পোশাক পরানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী রাতেই তাদের ফাঁসির আসামিদের জন?্য নির্ধারিত কক্ষ কনডেম সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাদের বেশ চিন্তিত বলে মনে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন এর আগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এ কারণে তাকে প্রধান ৪ আসামির সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদনের জন?্য হাই কোর্টে যাবে। আসামিরাও আপিলের সুযোগ পাবেন। হাই কোর্টের রায়ের পর আপিল বিভাগেও যাওয়ার সুযোগ থাকবে। এই বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা কার্যকর করা যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর