বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

র‌্যাব-পুলিশ সদস্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় ২৬ জনের ফাঁসির দণ্ডের রায় দেখে এলিট ফোর্স র‌্যাপিট অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও পুলিশ সদস্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। এ রায়ের মূল্যায়ন করে তারা বলেছেন, এটি যুগান্তকারী রায়। জাতিকে একটি বার্তা দিয়েছে। রায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী

বাহিনীর ভিতর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে। যারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তারা সতর্ক হবে। যারা ভালো, তারা খারাপ কাজ করার আগে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও চিন্তাভাবনা করবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী এ রায়কে খুব ইতিবাচক মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় ২৬ জনের ফাঁসির দণ্ডের এ রায় দেখে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়েছে। রায়ে অনেক শিক্ষণীয় দিক আছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমালোচনার অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায়ে আমি স্বস্তি প্রকাশ করছি। এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায় জাতিকে একটি বার্তা দিয়েছে। আর সেটি হলো, যারা পোশাক পরে অপরাধ করেন বা আইনের রক্ষা করতে গিয়ে অপরাধী চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন, তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিরসনে এ রায় বড় ভূমিকা রাখবে।’ তিনি বলেন, একটি বিষয় হলো যে, আইন তার নিজের গতিতে চলছে। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ রায় অনবদ্য নজির। আর রায় জাতিকে আশ্বস্ত করেছে। অপরাধী তিনি যিনিই হন না কেন, যত প্রভাবশালীই হন না কেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হন আর না হন, আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করলে আইনও তাকে আঁকড়ে ধরবে।’ আবদুর রশীদ বলেন, ‘আইনের এই শাসন প্রতিষ্ঠা জনমনে স্বস্তি দিয়েছে, সাধারণকে আস্থা দিয়েছে। আমরা যেসব চাঞ্চল্যকর অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেছি, যেগুলোর বিচার হয়নি বা ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে একটি বড় ধরনের দৃষ্টান্ত আমরা পেলাম। আর এ ধরনের কাজ থেকে তাদের বিরত রাখতে এ রায় অনবদ্য ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘এ রায় পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে যাবে। এটি আইনের চলমান প্রক্রিয়া। সে ক্ষেত্রে এ রায় যত দ্রুত হবে, রায় কার্যকর করার বিষয়টিও দ্রুত শেষ হবে। এ কথা ঠিক যে, সাত খুনের রায় জনমনে এক ধরনের স্বস্তি তৈরি করেছে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে এ রায় দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলেই আমি আশা করছি। একইভাবে এ রায়ের ফলে সাধারণের মধ্যে যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি আরও ভিত্তি পাবে। তবে রায় আদৌ কার্যকর হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। তবে আমি মনে করি এ রায় একটি অনবদ্য রায়।’ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাদিস উদ্দিন বলেন, অপরাধ করলে পার পাওয়া যায় না। অপরাধ করলে তার শাস্তি হবেই। নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের মামলার রায় এরই দৃষ্টান্ত। এ রায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভিতর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। যারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তারা সতর্ক হবে। আর যারা ভালো, তারা খারাপ কাজ করার আগে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও চিন্তাভাবনা করবে। হাদিস উদ্দিন বলেন, ‘এ রায়ের ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটছে তা অনেকাংশ কমে আসবে। লোভ-লালসার জন্যই কিছু কর্মকর্তা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। যারা অপরাধ করছে বা যারা অপরাধ করবে বলে চিন্তা করছে, এ রায়ে তারা সতর্ক হবে। রায়ের আদেশ শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলে অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে চেইন-অব-কমান্ড ভাঙার প্রবণতা অনেকাংশ কমে আসবে। এটি একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। এটি কঠিন বার্তাও বটে। এতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে তারা দেশসেবার মনোভাব নিয়ে কাজে মনোযোগী হবে। জনগণও তার কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে। কেউ কোনো বিপদে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই ছুটে আসে। তাদের কাজ মানুষকে সেবা করা, অত্যাচার করা নয়।’ সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায় খুবই ইতিবাচক। আলোচিত এ মামলার রায়ের জন্য দেশের প্রতিটি কর্নার থেকে মানুষ তাকিয়ে ছিল। এক দিনে সাতটি খুন! এক রাতেই লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এ খুনের ঘটনাই প্রমাণ করে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় কতটা হয়েছে। দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের মধ্যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবু জনগণ তখনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, যখন রায়টি পুরোপুরি কার্যকর করা হবে। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবেচনার কারণেই এ সংকট হবে। যেহেতু এখানে অনেক রাঘব বোয়ালের সন্তান-জামাতা বা বিভিন্ন বাহিনীর অনেক বেশি সদস্য জড়িত, সে বিবেচনায় রায় বাস্তবায়ন নিয়ে মানুষের কিছুটা উদ্বেগ থাকতেই পারে।’ তিনি বলেন, র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর অনেক ভালো কাজের পাশাপাশি সমালোচনাও আছে। আবার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তারা অনেক ভালো করেছে। যেমন মাদক নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গি দমনসহ নানা কাজ করেছে। সাত খুনের এ ঘটনায় জড়িত র‌্যাবের কতিপয় সদস্য। এর দায় র‌্যাবের নেওয়া উচিত নয়। র‌্যাবের নিজস্ব ইমেজ রয়েছে। তারা যদি দায়ভার নিতে যায়, তাহলে র‌্যাবের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। জনগণের একটা দাবি আছে, তা হচ্ছে রায়টি দ্রুত কার্যকর করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর