অনেক দিন পরে বাজারে গিয়েছিলাম। ঠিক কতদিন পরে, মনে করতে পারছি না। ১০ মিনিট হাঁটলেই বাজার, কিন্তু সকালে সেখানে গেলে আর লেখা হয় না। এখন একটা সকাল নষ্ট করা প্রায় বিলাসিতার সমান। কিন্তু কাজের মেয়েটি হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় ভাবলাম, আধঘণ্টার মধ্যে বাজার করে নিয়ে আসব। আগে বাজারের থলি হাতে থাকত। এখন কয়েক দিনের বাজার একবারে করতে হয় বলে থলির দরকার হয় না। সবজিওয়ালার ঠিক করে দেওয়া লোক ঝাঁকায় তুলে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। হাতিবাগানের এ বাজারের সামনে রাধা সিনেমা। সেখানে পৌঁছলাম ছিমছাম সকালে। রাস্তায় ওই সময় তেমন লোকজন নেই। হঠাৎ মনে পড়ে গেল— প্রে-স্ট্রিট ধরে আর একটু এগোলেই হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়, সেখানে ছিল স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রাবাস, রেসিডেন্স। তবে অন্য কলেজের ছাত্রও জায়গা পেত। আমরা বলতাম হরি ঘোষের গোয়াল। রাত ৯টার মধ্যে ঢোকার বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর কোনো শৃঙ্খল জোরদার ছিল না। মেস চালাত ছাত্রদের একটা কমিটি। প্রতি মাসে নতুন ম্যানেজার নির্বাচিত হতো। ম্যানেজার হওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। কথাটা চালু ছিল, যে ম্যানেজার হবে তাকে পকেট থেকে সেই মাসের মেস-ফি দিতে হবে না। সেটা একষট্টি সাল। আমি দ্বিতীয় বর্ষে। ম্যানেজার হলাম। পুরো মাসের টাকা আমার হাতে এলেও আমি তা হোস্টেল সুপারের কাছে রেখে দিয়েছিলাম। যখন দরকার হতো চেয়ে নিতাম। প্রথম দিন বাজারে গিয়েছিলাম হোস্টেলের ঠাকুর চৈতন্যের সঙ্গে। সকাল সকাল আমাকে ঘুম থেকে তুলে সে নিয়ে গিয়েছিল। বাজারের গায়ে একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে চা আর খবরের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সে বাজারে ঢুকে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে এসে টাকা নিয়ে যেত দাম মেটাতে। আধঘণ্টায় বাজার শেষ করে যখন ফিরতাম তখন চায়ের দাম দিতে দিত না চৈতন্য। দিতে চাইলে হাহা করে উঠত। বলত, ‘আপনি ম্যানেজারবাবু হয়ে চায়ের দাম দিচ্ছেন? এ দেখার চেয়ে আমার গঙ্গায় ডুবে যাওয়া ভালো।’
বাজারে ঢুকলাম। বাঁ দিকের উঁচু বাঁধানো জায়গায় পানের দোকানদাররা বসে। সব নতুন মুখ। ফলের দোকানদার নতুন লোক দেখে ডাকাডাকি করতে লাগল। নির্বিকার মুখে সেই আলুর দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোকটা নেই। এত বছর পরে থাকার কথা নয়। তখন আলুর সের ছিল চার আনা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আলু কত করে?’
‘একটু কমেছে। আট টাকা কিলো। কত দেব?’‘দাঁড়ান, একটু বাদে আসছি। পিয়াজ?’
হাসল লোকটা, ‘ষাট-সত্তর হয়ে গিয়েছিল, এখন বারো টাকায় পাবেন।’
তখন পিয়াজ কত করে ছিল? যতদূর মনে পড়ছে চার আনার বেশি নয়। অর্থাৎ এত বছরে আটচল্লিশ গুণ বেড়েছে। পাশেই ডিমের দোকান। যে দোকান থেকে ডিম কিনতাম সেখানে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। পাকা চুল, ভুরু সাদা, মুখে বলিরেখা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ডিম কত করে?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘পোলট্রি তিন টাকা পিস।’
স্মৃতি বলল, তখন টাকায় ছটা ডিম পাওয়া যেত। এখন ছটা ডিম আঠারো টাকা। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাসছেন কেন বাবু?’
‘আপনার দোকান তো বহুদিনের? পঞ্চাশ বছর আগে আমি আপনার দোকানে এসেছি।’
বৃদ্ধ অবাক। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি এসেছেন? আমি তো তখন দোকানে বসতাম। আমি ২৩ বছর বয়স থেকে দোকানে বসছি।’
‘আমি হোস্টেলের ম্যানেজার হিসেবে এসেছি চৈতন্যের সঙ্গে।’
‘চৈতন্য? হোস্টেলের কর্মচারী? খুব চিনতাম। বড্ড দরাদরি করত। শুনেছি সে মরে গিয়েছে। বলুন কটা ডিম দেব?’
একজন ঝাঁকা মুটেকে নিয়ে যত কেনাকাটা করছি তত অবাক হচ্ছি। কাটা পোনা কিনেছি আট টাকা কিলো, এখন দেড়শো। তার পরই মনে হলো সে সময় যিনি দুশো টাকা মাইনে পেয়ে দিব্যি সংসার চালাতেন তিনি এখন চাকরি করলে পঁচিশ হাজার টাকা মাইনে পেতেন। অর্থাৎ মাইনে বেড়েছে একশো পঁচিশ গুণ। তার ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের হাতে টাকা না থাকলে সিটি সেন্টার, বিগ বাজারগুলোতে এত ভিড় কী করে? আগে লোকে দেওঘরপুরীতে বেড়াতে যেত বছরে একবার। এখন ব্যাংকক-মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে স্বচ্ছন্দে।
যেহেতু বহু বছর পরে বাজারে এলাম, পুরো স্মৃতি মনে হুড়মুড়িয়ে এলো, তাই কীরকম অস্বস্তি হচ্ছে। মাছের বাজারের একদিকে মাটিতে বসে মাছ বিক্রি করত কিছু মানুষ, এখনো করছে। সাধারণত জিওল মাছ বলা হয়, মাগুর, সিঙি, কই ইত্যাদি নিয়ে বসেন তারা। মাছগুলো সেই আগের চেহারাতেই আছে। লোকগুলো বদলে গিয়েছে। হঠাৎ একটি ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওকে আমি চিনি। ওর কাছ থেকে আমি কই মাছ কিনেছি। আমাকে তার দিকে তাকাতে দেখে ছেলেটি বলল, ‘আসুন বাবু, এই কই মাছ কড়াইতে দিলেও লাফাবে।’ কথাটা শোনামাত্র বুকের ভিতর কিছু গলগলিয়ে উঠল। যে লোকটি ওখানে বসত সে-ও তো একই কথা বলত। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই দোকানে কি তোমার বাবা বসতেন?’
‘হ্যাঁ। বাবা মারা গিয়েছেন।’
‘তুমি কি তার মতো দেখতে?’
ছেলেটি লাজুক হাসি হাসল, ‘হ্যাঁ। সবাই তাই বলে।’ পাশের প্রৌঢ় বললেন, ‘ওর বাবার কথা বলার ধরনও ও পেয়েছে বাবু।’
হঠাৎ মনে হলো, যতই দাম বাড়ুক, চৈতন্যেরা চলে যাক, আসলে কিছুই বদলায়নি।