বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

আদালতের চেয়ে ক্ষমতাশালী বিজিএমইএ

মানে না সরকারি নির্দেশও, অসহায় রাজউক বলছে ভবন ভাঙতে তারা প্রস্তুত

রুহুল আমিন রাসেল

আদালতের চেয়ে ক্ষমতাশালী বিজিএমইএ

রাজধানীর হাতির ঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিজিএমইএ ভবন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

আইনকানুন, সরকার, আদালতের নির্দেশ, পরিবেশের প্রতি হুমকি কোনো কিছুই মানে না গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। অবৈধ ১৬ তলা ভবনটি ভাঙতে আদালতের নির্দেশ নিয়ে রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা দিনের পর দিন গড়িমসি করছে। বিজিএমইএ জনগণের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে একদিকে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে রাজউককে ভাঙার কাজে নিরুৎসাহিত করতে লবিং করছে নতুন করে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সর্বস্তরে আইন ভাঙার অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই বিজিএমইএ এ ধরনের কাজ করছে। তবে রাজউক চেয়ারম্যান বলছেন, ৯০ দিন পার হলে তারা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।

 বিজিএমইএ ভবন ভাঙা-সংক্রান্ত আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি রাজউক পেয়েছে ২৮ নভেম্বর। রায় অনুযায়ী, নিজ খরচে ভবনটি ভাঙতে হবে বিজিএমইএ-কে। আর এ জন্য ৯০ দিন বা আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে আদালত। অর্থাৎ বিতর্কিত এই ভবন ভাঙতে আর এক মাসের চেয়ে কিছু সময় বেশি পাবেন তৈরি পোশাক মালিকরা। অন্যথায় আদালতের রায় অনুযায়ী ভবন ভাঙবে রাজউক। সেই প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে রাজউক। কিন্তু এরই মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে ‘রিভিউ’ আবেদন করেছে বিজিএমইএ। তবে আদালতের রায় মেনে ভবন ভাঙতে রাজউকের প্রস্তুতি থাকলেও উদ্যোগ নেই বিজিএমইএর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরং রায় বাস্তবায়নে তারা নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে। অতিমুনাফার লোভে ভবনের বেশির ভাগ ফ্লোর বিক্রি করে দিয়েছে পোশাক মালিকদের এই সংগঠন। পরিবেশবাদী সংগঠনের একজন নেতা বলেন, আদালত তার রায়ের এক স্থানে বলেছে, ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।’ ভবন ভাঙার বিষয়ে সংগঠনটি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করার মধ্য দিয়ে আদালতের রায়কেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে বিজিএমইএ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভবন ভাঙার প্রস্তুতি জোরেশোরে চলছে রাজউকে। ভাঙার ব্যয় ও সময় নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাজউকের প্রকৌশল বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে বাছাই করা কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভবন ভাঙার দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে রাজউকের ওই সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদালতের রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে স্বয়ং বিজিএমইএ-কেই তাদের ভবন ভাঙতে হবে। অন্যথায় রাজউক ভবনটি ভেঙে ফেলবে। আর ভবন ভাঙতে যে খরচ লাগবে, তাও বিজিএমইএর কাছ থেকে আদায় করা হবে। সবকিছুই করা হবে আদালতের রায় অনুযায়ী। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা রিভিউ পিটিশন দিয়েছি। এ নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আমাদের করণীয় ঠিক করব।’ পরিবেশবাদীদের সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদালত তার পূর্ণ বিবেচনায় রায় দিয়েছে, যা সব মহলকে উদ্যোগী করার জন্য যথেষ্ট। তবে রিভিউ আবেদন করার অধিকার তাদের (বিজিএমইএ) রয়েছে। এর মানে দাঁড়ায় যে, রাষ্ট্র তথা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী রায়টি দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করবে। দ্রুত নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, এটাই প্রত্যাশিত।

পবার যুগ্ম-সম্পাদক ডা. লেনিন চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইন গরিবের জন্য দ্রুত প্রয়োগ হয়, ধনীদের জন্য নয়। ফলে আমরা দেখি, অন্যায়ভাবে তৈরি হওয়া বিজিএমইএ ভবন ভাঙার ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হয় না।’

বিজিএমইএর বিতর্কিত ও অবৈধ ভবন ভাঙতে হাই কোর্টের দেওয়া নির্দেশ বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রকাশিত হয়। এর আগে জমির স্বত্ব না থাকা এবং জলাধার আইন লঙ্ঘন করে রাজধানীর হাতিরঝিলের দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প এলাকায় নির্মিত বিজিএমইএ ভবনটি ভাঙতে পাঁচ বছর আগে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। ওই রায়ের পর বিজিএমইএ লিভ টু আপিল করে। আপিলের সেই আবেদন ২০১৬ সালের ২ জুন খারিজ করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। পরে একই বছরের ৮ ডিসেম্বর ওই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ রিভিউ আবেদন করেছে, যা এখন আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাই কোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। হাই কোর্ট বলেছে, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিল বেআইনি। কারণ ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না। তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিত ছিল যে এ জমির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়। এ ভবনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে’ শক্তিশালী একটি মহলকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে’—এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, বিজিএমইএ ভবন সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, পুরো ঢাকা শহরকে সংক্রমিত করবে। এ ছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্প একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। কাজেই সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ওপর নির্দেশ হলো, ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হবে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষে ২০০৬ সালে ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের দাবি, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ লঙ্ঘন করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ী খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয় এবং এতে খালের গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

সর্বশেষ খবর