বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঢাকা ছাড়তে চায় না বিজিএমইএ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় যে গার্মেন্ট শিল্প পার্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা, ছয় বছর পর দেখা যাচ্ছে—তার পুরোটাই রয়েছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে এর কোনো অগ্রগতি নেই। ভবিষ্যতেও এই শিল্প পার্ক স্থাপনের সম্ভাবনা নেই বলে এখন গার্মেন্ট মালিকরাই সরকারকে বলছেন।

এতদিন শোনা যাচ্ছিল চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এখন বিজিএমইএ বলছে, চীনের ওই কোম্পানি টাকা দিতে চায় না। আদতে গার্মেন্ট মালিকরা ঢাকা থেকে কারখানা স্থানান্তর করতে চান না বলেই মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্ট পল্লী স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না—এমন অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমাতে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরের বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হয়। পরে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ওই শিল্প পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিজিএমইএ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং করপোরেশন লিমিটেডের (ওআইএইচ) যৌথ উদ্যোগে মুন্সীগঞ্জে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে বিজিএমইএর সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তিও হয়েছিল। এখন বিজিএমইএর অসহযোগিতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিল্প পার্ক স্থাপনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দফায় দফায় নানা উদ্যোগ নিতে বিজিএমইএকে অনুরোধ করা হলেও সাড়া দেয়নি বিজিএমইএ। সূত্র মতে, গার্মেন্ট মালিকরা রাজধানীর বাইরে কারখানা স্থানান্তর করতে আগ্রহী নন। কারণ যেসব শিল্প মালিকের কারখানা ভাড়াটে কিংবা অংশীদারী ভবনে তাদের জন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত শিল্প পার্কে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএর নেতৃত্বে থাকা বড় বড় শিল্প মালিকদের তেমন কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছেন তারা। তাই এ প্রকল্পে তেমন আগ্রহও নেই বিজিএমইএর। আর গত বছরের জুলাইয়ে যখন চীনা প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের ১০ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে আসে, তখন তাদেরও গার্মেন্ট মালিকদের এই মনোভাব আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে চীনা প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর পোশাকশিল্প মালিকরা এখানে প্লট নাও কিনতে পারেন। চুক্তির পরও চীনা প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার এটি একটি বড় কারণ হতে পারে। অবশ্য অসহযোগিতার বিষয়টি স্বীকার না করে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বরং চীনা কোম্পানিটির ওপর দায় চাপানো হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিজিএমইএর উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গার্মেন্ট শিল্প পার্ক স্থাপন প্রকল্পটি এখন বলা যায় স্থবির। কারণ চায়নিজ প্রতিষ্ঠান ওআইএইচ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আর কোনো সম্ভাবনা আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর এই উপদেষ্টা জানান, সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার সাধ্য তার নেই। সূত্র জানায়, মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্ট শিল্প পার্ক স্থাপনে ধীরগতির বিষয়টি নিয়ে গত নভেম্বরে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জহির উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিজিএমইএর প্রতিনিধি সংগঠনটির উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত হোসেন জানান, গার্মেন্ট শিল্প পার্ক নির্মাণে ওআইএইচের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এ বিনিয়োগে তারা কতটুকু লাভবান হবে—সে বিষয়ে শঙ্কায় রয়েছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জহির উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্ট শিল্প পার্ক স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ চায়নিজ কোম্পানিটি আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে আমাকে জানানো হয়েছে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে। তবে ওই শিল্প পার্ক স্থাপনে গার্মেন্ট মালিকদের অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না—সেটি আমার জানা নেই। জানা গেছে, প্রকল্প গ্রহণের শুরু থেকেই মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্ট শিল্প পার্ক স্থাপনে টালবাহানা করছে বিজিএমইএ। ২০১০ সালের ৭ জুলাই মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য শিল্প পার্ক স্থাপনে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক ২০১৩ সালের শেষ দিকে গজারিয়ার বাউশিয়া, মধ্যম বাউশিয়া, পোরারচক, চৌদ্দকাহনিয়া মৌজায় ৪৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, যার মূল্য ছিল প্রায় ৭৭৮ কোটি টাকা। এরপর জমির মালিকদের পাওনা পরিশোধে বিজিএমইএর কাছে অর্থ চেয়ে ২০১৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তিনটি চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু বিজিএমইএ অর্থ পরিশোধ করেনি। অর্থ না পেয়ে নিরুপায় জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে দেয়। এত কিছুর পরও গজারিয়ায় গার্মেন্ট শিল্প পার্কটি স্থাপনে সরকার বিজিএমইএ-এর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে এ বিষয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান ওআইএইচ-এর সঙ্গে বিজিএমইএর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। চীনা ওই কোম্পানিটি প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে শিল্প পার্ক স্থাপনে সম্মত হয়। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, শিল্প পার্কের উন্নয়নে ওআইএইচ-কে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিজিএমইএর আবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তি দেওয়া হয়। এরপর ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর চীনা কোম্পানিটির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠনটি। ওই কাঠামো চুক্তি অনুযায়ী ওআইএইচ এবং বিজিএমইএর যৌথ উদ্যোগে গার্মেন্ট শিল্প পার্ক স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চায়নিজ প্রতিষ্ঠানটি শিল্প পার্ক স্থাপনে একটি সমীক্ষাও করে। এ অবস্থায় বিজিএমইএ ঘটা করে বলছে, চায়নিজ ওই প্রতিষ্ঠানটি না কি বিনিয়োগটিকে লাভজনক মনে করছে না।

সর্বশেষ খবর