বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

জেলায় জেলায় আতঙ্ক ছিলেন তারেক সাঈদ

সাখাওয়াত কাওসার

জেলায় জেলায় আতঙ্ক ছিলেন তারেক সাঈদ

২০১৪ সালের ২৯ মার্চ। কুমিল্লা জেলার যুবলীগ নেতা রকিবুল হাসান শাওনকে তার মোন্সেফ কোয়ার্টারের নিজ বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে শাওনের পরিবার জানতে পারে, এ ঘটনায় নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। শাওনের মা আনোয়ারা বেগম ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কুমিল্লা আদালতে ১৫ জন র‌্যাব সদস্যের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। সিআর মামলা নম্বর-৩৭২/১৪। জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ র‌্যাব সদস্যদের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি দাবি করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। শাওনের মা আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে গতকাল কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার শাওন কেমন ছিল তা এলাকাবাসী জানে। শাওনকে যে গাড়িতে করে তুলে নেওয়া হয়, সেই গাড়িতে স্থানীয় এনামুল নামে আরও একজন ছিল। এক দিন পর এনামুলকে থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। তবে শাওনকে ফেরত দেওয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘শাওনের বাবা আবদুল মতিন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে এভাবে গুম করতে এতটুকুও বুক কাঁপেনি তারেক সাঈদের। শাওনের ঘটনায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’       

এ তো গেল একটা ঘটনা। র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে এ রকম অসংখ্য অভিযোগ এসেছিল র‌্যাব সদর দফতরে। তিনি দায়িত্বে থাকাকালে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার এলাকায় বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। ক্ষমতাসীন পরিবারের আত্মীয় হওয়ার কারণে তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আমলে নেওয়া হয়নি বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। অনেক কর্মকর্তাই তারেক সাঈদকে সমীহ করে চলতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা হলেও তদন্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযোগের জন্য আলাদা বিচার হওয়া উচিত। এত দিনে মনে হয় এটা প্রমাণিত হলো, র‌্যাবের বিপথগামী সদস্যরা কন্ট্রাক্ট কিলিং ও গুমের সঙ্গে জড়িত। নৃশংস এসব ঘটনার বিচার হলে গুম হয়েছেন এমন হতভাগাদের স্বজনরা একটু হলেও স্বস্তি পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।’  জানা গেছে, শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, জেলায় জেলায় আতঙ্ক ছিলেন র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। বহু নিরপরাধ মানুষের কাছে তারেক সাঈদ ছিলেন রীতিমতো যমদূত। গতকাল পর্যন্ত গুম-খুন-অপহরণের কমপক্ষে এক ডজন অভিযোগ পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তবে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের দাবি, প্রতিটি ঘটনায় যেন তারেক সাঈদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার প্রকৃত চরিত্র জনসম্মুখে যেন প্রকাশ করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহ্দীন মালিক বলেন, সাত খুনের ঘটনার হোতা হিসেব তারেক সাঈদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে আদালত। তার বিরুদ্ধে আনা সব মামলার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত হতেই হবে। লাকসাম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে কুমিল্লা আসার পথে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর অপহৃত হন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ। ওই ঘটনায় অপহৃত ব্যক্তিদের স্বজনেরা আদালতে তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে এক নম্বর আসামি করে মামলা করেন। ওই ঘটনায় বাদীপক্ষের আইনজীবী বদিউল আলম বলেন, হিরু, পারভেজসহ চারজনকে তুলে নিলেও পরে বাকি দুজনকে ছেড়ে দেয় র‌্যাব। র‌্যাবের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা নিতে চায়নি লাকসাম পুলিশ। একটা নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে কুমিল্লা আদালতে মামলা করা হয়। আদালতের নির্দেশে পুলিশ তদন্ত করে এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, তারা র‌্যাবের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে নারাজি দেওয়ায় মামলাটি সিআইডিকে দেওয়া হয়। সিআইডি জানায়, অপহরণের পর পরিবার থানায় যে জিডি করে, পুলিশ সেই জিডির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি। আগের তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষীদের যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, সেই কাগজপত্র তারা পায়নি। সে কারণে তাদের দেরি হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন সাবুর বাসা র‌্যাব-১১-এর একটি দল ঘেরাও করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে একটি মামলার এজাহারে। ওই দিন বাসার সামনে রাখা তাদের দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিহত জুয়েলের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘সাহাব উদ্দিন সাবুর বাসা ঘেরাও করা হয়েছে শুনে আমার স্বামী ইকবাল মাহমুদ জুয়েল বাসা থেকে বের হয়। ১৫-২০ মিনিট পর সদর হাসপাতাল রোডের বাসায় বসে আমি তিনটা গুলির শব্দ পাই। কিছুক্ষণ পরই খবর আসে জুয়েল জায়গাতেই মারা গেছে। লাশটা পর্যন্ত দেয়নি।’ তিনি বলেন, কোনো অবস্থায় যেন তারেক সাঈদ ছাড়া না পান, সে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আদালত একটি ঘটনায় রায় দিয়েছে। রায় কার্যকর হলে তারা স্বস্তি পাবেন। ওই একই সময়ে জামায়াতের আমির ফয়েজ আহম্মেদকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে র‌্যাব-১১-এর বিরুদ্ধে। গুম-সংক্রান্ত সম্মেলনে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে এ অভিযোগ করা হয়। তবে এখন আর তারা কোনো কথা বলতে চান না। অপহরণের ১৩ দিন পর মেঘনা নদীতে ভেসে ওঠে পেটচেরা একটি লাশ। এটি ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামের বলে শনাক্ত করেন তার বাবা। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁয়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাজুলকে একটি হাইয়েস গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় একটি মামলা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে গুমবিরোধী একাধিক মানববন্ধনে অভিযোগ করা হয়েছে, ওই হাইয়েস গাড়িতে করে র‌্যাব-১১-এর সদস্যরাই তাজুলকে অপহরণ করে নিয়ে গেছেন। মামলার তদন্তে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, তাজুল অপহৃত হন একটি বিরোধকে কেন্দ্র করে। সেই বিরোধে র‌্যাব-১১-এর সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু গুমের ঘটনা প্রমাণে যে তথ্যপ্রমাণ দরকার, তা পুলিশ জোগাড় করতে পারেনি। পরে পুলিশ তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা থেকে বালু ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন অপহৃত হন। তার পরিবার বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার র‌্যাব-১১-তে গেছে। সাত খুনের ঘটনার পর ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর তারেক সাঈদসহ আরও ২৪ জনের নামে ইসমাইলের স্বজনেরা অভিযোগ দাখিল করেন। স্বজনেরা এখন বলছেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মদের সহযোগিতায় ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন নূর হোসেন।

 

সর্বশেষ খবর