শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিজ্ঞাপন দেখুম না টিভি গোল্লায় যাক

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

বিজ্ঞাপন দেখুম না টিভি গোল্লায় যাক

পঞ্চাশ বছর ধরে টিভি অনুষ্ঠান করছি। কিছু অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হয়েছেন, তাদের চেয়েও আমি  সিনিয়র। কাজেই কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। আপনারা টিভি চালাতে অনভিজ্ঞ। তাই ওগুলো বন্ধ হয়ে যাবে শুধু বুদ্ধির অভাবে। এতগুলো টিভি চ্যানেলের প্রয়োজন ছিল না, কারণ অভিজ্ঞ প্রডিউসারের অভাব, কল্পনাশক্তি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে যে নাট্যকাররা দর্শকদের ধরে রাখবেন, তাদের অভাব, নতুন নাট্যকাররা সাফল্য পাচ্ছেন না। তাই আমাদের টিভি মার খাচ্ছে। এতে আমাদের সবার মন খারাপ।

বছর কুড়ি আগে কোচবিহার গিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে সবাই চেনে। কারণ ঢাকার টিভি সবাই দেখে। প্রতিটি আর্টিস্টকে তারা চেনে। একটি চাকরির ইন্টারভিউতে একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো ভারতের প্রেসিডেন্টের নাম কি? প্রতিযোগী বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সমস্ত উত্তর বাংলাজুড়ে বাংলাদেশের টিভি। তারা সবাই এক কথায় চেনে মুস্তাফা মনোয়ারকে, হুমায়ূন আহমেদকে, আলি যাকেরকে, আমাদের সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। এখন ভারতে এক হাজার চ্যানেল। তারা বাংলাদেশের কাউকেই চেনে না। কারণ, কোনোখান থেকেই বাংলাদেশ দেখা যায় না। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের কথা, বাংলাদেশের দর্শকরাই এখন চলে গেছে ওদের দখলে। তার কারণ কি? এটা নিয়েই ভাবছিলাম কয়েক দিন। প্রথম কথা, যারা ওদের নাটকের গল্প লেখেন, তারা এত সুন্দর প্লট তৈরি করেন যে, সেগুলো না দেখে রাতে আর কেউ ঘুমোতে যায় না। আমরা বাংলাদেশের শিল্পী, বাংলাদেশের সব কিছুই আমাদের বেশি ভালো লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তা হলে এক্ষেত্রে উল্টোটা কেন? আমার বাড়িতে তিনটি টিভি। একটি ড্রইংরুমে অনেক বড় টিভি, ছোট মেয়ে দিয়েছে। খাওয়ার ঘরে মানানসই ছোট টিভি, বড় মেয়ে দিয়েছে। আর শোয়ার ঘরে বেশ দামি টিভি, আমি দিয়েছি আমার স্ত্রীকে বিবাহ বার্ষিকীতে। এই তিনটিই এখন ‘জি’-র দখলে। আমার প্রোগ্রাম হলে তারা বলে তোমারটা পরে দেখব। কেন এমনটি হলো? প্রথম কারণ টিভি চেনে না এমন লোক টিভি চালাচ্ছে। এটা জানতে হয়। আমি একটি প্রোগ্রাম করতাম বহু বছর। নাম : ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘লৌকিক বাংলা’। নানা নদীর বাঁকে তরুণ আব্বাসীকে সেদিন দেখা যেত নতুন পাঞ্জাবি পরে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চয়ন করা হতো নাম না জানা গায়ক, গায়িকা ও গৃহবধূ, যারা কোনো দিন গান গায়নি। ভাটিয়ালি, রাখালি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদি, ভাওয়াইয়া, চটকা, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, ধামাইল, কোনো কিছুই বাদ ছিল না। দেশের সব অঞ্চল থেকে লোকসংগীত শিল্পীরা আমার বাসায় এসে হাজির। তাদের চা খাওয়াতাম, সঙ্গে একটি লাঠি বিস্কিট। নতুন অনুপ্রেরণায় প্রতিটি শিল্পী উদ্ভাসিত। তারা যেসব গান শুনিয়েছে প্রতি মাসে তার অনেকগুলো এখন অবলুপ্ত। শিল্পীরা এখন অনেকেই নেই। পরপারে। আবদুল আলিম, আবদুল লতিফ, আবদুল হালিম চৌধুরী, এরা কোথায় হারিয়ে গেলেন? বাংলার মানুষ অপেক্ষা করত ওই একটি দিনের জন্য। আমার জন্য নয়। যারা বাংলার শ্রেষ্ঠ লোকসংগীত শিল্পী, তাদের জন্য। আমি তাদের মালাকার। সমস্ত দেশ থেকে এর জন্য পেয়েছি প্রশংসার ডালি। যে পদকগুলো আপনারা দেন প্রতি বছর তার চেয়েও অধিক দামি। এগুলো জনতার পদক, জনতার ভালোবাসার মালা। সে মালা এখনো আমার গলে। এখনো টিভিদেরকে বিনে পয়সায় কিছু উপদেশ দিতে পারি, যা তাদের কাজে আসবে। ওরা আমাদের উচ্ছিষ্ট মনে করে বাদ দিয়েছে। সবাই দিয়েছে তা নয়। বেশির ভাগই আমাদের চেনে না। তা হলে তোমাদের ভাগ্যে হবে সম্পূর্ণ অবহেলা। আমি আগেই বলেছিলাম যে, এগুলো কেউ দেখবে না। এখন তাই হয়েছে। কেউ বাংলাদেশের প্রোগ্রাম দেখে না। কেন দেখে না? একটি অনুষ্ঠানের সিংহভাগ বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন বানাতেও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিতে হয়, যা লোকে বারবার দেখবে। সে কারণেই বিদেশে সবচেয়ে পপুলার লোকদের বিজ্ঞাপনে টানা হয়। ভারতে অমিতাভ বচ্চনকে দেখে কেউ ক্লান্ত হয় না। বারবার তাকে দেখতে ইচ্ছা করে। আমিও বাদ নই। তেমনি যারা নাম করা মানুষ তাদের এক নজর দেখলেও মনটা প্রফুল্ল হয়। এটা বুঝতে হবে, কারা সেই প্রফুল্ল কান্তি, কারা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, কাদের কথা লোকে পছন্দ করে।

এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। আপনারা বসুন এবং আলোচনা করুন। কীভাবে দর্শকদের পশ্চিম থেকে আবার পুবে ফেরান যায়। কদিন আগে ভারত থেকে এলাম। সেখানে এক হাজার টিভি। আগে একটাও ছিল না। এতে অসুবিধাও হয়েছে। তা হলো একটি স্টেশন খুঁজতে এক ঘণ্টা লাগে। পশ্চিমবঙ্গের টিভিগুলোর প্রশংসা করার কারণ আছে। তারা বেস্ট ট্যালেন্টদের সেখানে টেনে এনেছে। সেখানকার শ্রেষ্ঠ গল্পকার, শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, সবচেয়ে দেখতে সুন্দর নায়িকাদের, একজনের চেয়ে আরেকজন সুন্দর, সবচেয়ে ভালো নৃত্যশিল্পী, সবচেয়ে ভালো যন্ত্রি, সবচেয়ে ভালো এডিটর, সবচেয়ে ভালো রূপসজ্জাকর, সবচেয়ে ভালো অ্যারেঞ্জার, সবচেয়ে ভালো প্রডিউসার। অর্থাৎ যারা টেলিভিশনকে ভালোবাসে। প্রতিটি প্রোগ্রামের জন্য ব্যয় হচ্ছে কোটি টাকা। তাই কোটি কোটি শ্রোতা। প্রতিটি প্রোগ্রামের জন্য ব্যয় হচ্ছে অনেক ঘণ্টার রিহার্সাল। শিল্পীদের পেছনে খরচ। শিল্পীরা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। তারা সবাই গাড়ি কিনেছে। বাসে করে আর নয়। তাদের কাপড়-চোপড়, তাদের সাজসজ্জা অনেক বড়লোককেও হার মানায়। নিউ মার্কেটে ওদের দেখার জন্য শত লোক সকাল থেকে বসে আছে। সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা এখন পেয়েছে উত্তম-সুচিত্রার মর্যাদা। ওদের সঙ্গে সবাই সেলফি তুলতে চায়, ওদের সঙ্গে কথা বলবে। শিল্পীদের এত সম্মান। আমি গিয়েছি নিউ মার্কেটে এক ঘণ্টার জন্য। কয়েক ডজন মেয়ে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে আমাকে। আমার জন্য নয়, আমার পিতার জন্য। পিতাকে তারা দেবতার আসনে বসিয়েছে। আর নিজ দেশে বছরে একদিনও তার স্মরণ হয় না। নজরুলের ভাগ্যেও তাই। নজরুল-আব্বাসউদ্দিন পড়াই। ছেলেমেয়েরা তাকে চেনে না। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত কোনো বইয়ে ওরা উপস্থিত নেই। আমরা বাঙালি হতে শিখছি না অথবা নিজেদেরকে নিজেরাই ভুলে যাচ্ছি। আমরা শংকর জাতি হতে চলেছি। তাই কি হওয়া উচিত? আমার দাবি এবং অনুরোধ আমাদেরকে সংযুক্ত করুন, উপদেশ নিন। পয়সা চাই না। আমাদের টেলিভিশনকে আবার দর্শকদের সামনে ফিরিয়ে দিন।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী, সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব, [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর