রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

কারসাজির নায়করা ফের মাঠে

আলী রিয়াজ

কারসাজির নায়করা ফের মাঠে

শেয়ার কারসাজির নায়করা আবারও মাঠে নেমেছেন। নতুন করে শেয়ার কারসাজিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটকারীরা নতুন করে মাঠে নেমেই গুজব, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে কারসাজি শুরু করেছেন। সম্প্রতি কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল, জেড ক্যাটাগরির শেয়ারের দর বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে দিন দিন শেয়ারবাজারের সূচক লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরগরম হয়ে উঠেছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ১১ ধরনের কারসাজি চিহ্নিত করেছে। এভাবে অস্বাভাবিক বাজার বৃদ্ধিতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ—ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারের স্থায়ীভাবে যৌক্তিক, গতিশীল, স্থিতিশীল অবস্থা চাই। কোম্পানির মৌলভিত্তি ইপিএস, এনএভি, পিই রেশিও, উদ্যোক্তা যাচাই করে বিনিয়োগ করতে হবে। সচেতন বিনিয়োগকারীই বাজারের উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

জানতে চাইলে ২০১০ সালে শেয়ার কারসাজির তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকের ডিপোজিট সুদহার কমায় অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। তবে তার পরিমাণ এত নয়। এ সুবিধা নিয়ে কারসাজিকারীরা সুযোগ নিচ্ছেন। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে যারা কারসাজি করেছেন তারা মাঠে নেমে গেছেন। এদের নাম হয়তো বলা যাবে না কিন্তু ডুবসাঁতারের মতো পানির ঢেউ থেকে বলা যায় নিচে কেউ আছে। এখানেও তাই হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাজার সক্ষমতায় যে বৃদ্ধি হয়েছে তা বড় কিছু নয়। তবে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এত ওপরে ওঠা অবশ্যই আশঙ্কার। দেখা যাচ্ছে দুর্বল, জেড ক্যাটাগরির শেয়ার দর বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে কেউ না কেউ জড়িত আছেন, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বেশি মুনাফার আশায় বিনিয়োগ করে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ডিএসইর বাজার লেনদেন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গত সাত সপ্তাহে ডিএসইর সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৭০০ পয়েন্টের বেশি। সর্বশেষ ডিএসইএক্স দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৩৪ পয়েন্টে। ডিসেম্বরের শুরুতে সূচক ছিল ৪ হাজার ৮২৩ পয়েন্ট। ২০১৩ সালে সাধারণ সূচক বাদ দিয়ে ডিএসইএক্স সূচক চালুর পর এটা ডিএসইর ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সাধারণ সূচক ৪ হাজার পয়েন্ট থাকা অবস্থায় চালু করা হয় ডিএসইএক্স সূচক। সাধারণ সূচক চালু অবস্থায় ২০১১ সালের অক্টোবরে সাড়ে ৫ হাজার সূচক অতিক্রম করেছিল। লেনদেনে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছর ধরেই ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৫০০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ডিএসইর গড় লেনদেন ছিল যথাক্রমে ৪৯৯, ৪২১ ও ৪৯৪ কোটি টাকা। এ সময় কয়েক দিন ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা হলেও হাজার কোটির লেনদেন ছাড়ায়নি এক দিনও। ২০১৭ সালের শুরুতে মাত্র ১৫ কার্যদিবসে গড় লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। গত নভেম্বরের পর হঠাত্ লেনদেন হারে ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা যায়। এ দেড় মাস ধরেই লেনদেন হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে। কয়েক দিন ২ হাজার কোটি টাকায় লেনদেন হয়েছে।

গত এক সপ্তাহের লেনদেনের পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি; যা গত দেড় মাসে বেড়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ আগের এক বছরে বাজার মূলধন বেড়েছে মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকে আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় এবং বিনিয়োগ কম হওয়ায় অনেকে শেয়ারবাজারে টাকা লগ্নি করছেন। দীর্ঘদিন ধরে মন্দা থাকায় অনেক শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত ছিল। তাতে দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি লগ্নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় কিছুটা উদ্বিগ্ন বিএসইসি ও ডিএসই কর্তৃপক্ষও। বিএসইসি ১৬ জানুয়ারি দুই স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে ১১ ধরনের কারসাজির বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। কৃত্রিমভাবে শেয়ার দরের উত্থান-পতন ঘটাতে এসব কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয় বলে তারা জানায়। এই ১১ ধরনের কারসাজি হলো : স্বয়ংক্রিয় গ্রাহক (অটো ক্লায়েন্ট), শেয়ার না থাকার পরও বিক্রি (শর্টসেল), সামনে চলমান গ্রাহক (ফ্রন্ট রানিং ক্লায়েন্ট), চক্রাকার লেনদেন (সার্কুলার মুভমেন্ট), প্রতারণা (স্পুফিং), লেনদেন একাগ্রতা (ট্রেড কনসেনট্রেশন), বিজ্ঞপ্তি সতর্কতা (প্রেস রিলিজ ওয়ার্নিং), সুবিধাভোগী প্রকৃত গ্রাহক (ইনসাইডার টার্নওভার নেট ক্লায়েন্ট), সর্বশেষ অবস্থান সূচক (মার্কিং দ্য ক্লোজ), সর্বশেষ মূল্য (ক্লোজিং প্রাইজ), কারসাজি ও আদেশের বিস্তার (অর্ডার স্প্রেড)। এর বেশ কয়েকটি অভিনব বলে বাজারসংশ্লিষ্ট অনেকে জানিয়েছেন। এর মধ্যে অটো ক্লায়েন্ট কারসাজিতে একই ব্যক্তিকে ক্রেতা ও বিক্রেতা হিসেবে পাওয়া যায়। একাধিক বিও (বেনিফিশারি ওনার্স) হিসাব খুলে নিজের মধ্যেই লেনদেন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে থাকেন। ফ্রন্ট রানিং ক্লায়েন্ট কারসাজিতে বড় শেয়ার কেনার সংবাদ আগে কেউ পেয়ে শেয়ার কিনে দর বৃদ্ধি করেন। স্পুফিং সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ ব্যবস্থায় শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে লেনদেন যন্ত্রে বিপরীতমুখী কিছু আদেশ দিয়ে দর প্রভাবিত করা হয়। সংবাদ সম্মেলন করে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান বলেছেন, ধারদেনা, গয়না বিক্রি, বাড়ির গরু বিক্রি করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের দরকার নেই। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কোম্পানি সম্পর্কে জেনেবুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। ছয় বছর ধরে বাজার পড়তির দিকে হলেও এই বছরের শুরু থেকে তেজিভাব দেখা যাচ্ছে। তবে সূচক ও লেনদেন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ভয়ের কোনো কারণ নেই। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শেয়ারবাজারে বর্তমানে যে সূচক ও লেনদেন হার আছে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এত দ্রুত বাজার উঠে যাওয়ায় কিছুটা শঙ্কা তৈরি করেছে। প্রশ্ন তুলছে, কেন এত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সঙ্গে বাজার কারেকশনও হচ্ছে না। একটানা উঠেই যাচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। এ ছাড়া দুর্বল, জেড ক্যাটাগরির শেয়ারের দর বাড়ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার মানে বাছবিচার না করে বিনিয়োগ হচ্ছে। দ্রুত মুনাফার আশায় কিছু ট্রেডার এমনটি করতে পারেন। এরা বিনিয়োগকারী নন, ট্রেডার। আমার মনে হয় এগুলো অস্বাভাবিক, তাই সবাইকে সাবধান হতে হবে। এখন বিএসইসির উচিত এক দিন বা একবার নয়, সার্বক্ষণিক এসব শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে নজরদারি করা। কারা বাজারে অস্বাভাবিক লেনদেন করছেন সেগুলো নজরদারির আওতায় আনা। খুব ভালোভাবে এগুলো দেখতে হবে।’ একই সঙ্গে যাদের লাখ লাখ শেয়ার আছে সেগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। এ ছাড়া সব সময় কঠোর নজরদারি রাখতে হবে বাজারের ওপর। বিনিয়োগকারীদেরও সচেতন থাকতে হবে।

সর্বশেষ খবর