সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমস্যার শেষ নেই পুলিশে

মানবেতর জীবন-যাপন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম, লক্কড় ঝক্কড় গাড়ি, খাবার-ড্রেস সব কিছুতেই সংকট

আলী আজম

সমস্যার শেষ নেই পুলিশে

পুলিশে সমস্যার অন্ত নেই। নানা সমস্যায় অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটির প্রতিটি সদস্যকে। জনবল সংকট থেকে শুরু করে খাবার ও আবাসন সংকটে একরকম দুর্বিষহ জীবন কাটান বাহিনীর সদস্যরা। অন্যদের শান্তির বিধান করে নিজেরাই থাকেন ভোগান্তিতে। আবাসন সংকট এতই প্রকট যে, সারা দিন হাড়ভাঙা ডিউটির পর বিশ্রামের জন্য ব্যারাকে ফিরে তাদের দেখতে হয়, নিজের জন্য বরাদ্দ সিটে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন আরেকজন। মানবিক কারণেই তখন তাকে আর ডেকে তোলা যায় না।

জানা যায়, বর্তমানে এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৩৮ জন। এর বিপরীতে যানবাহন রয়েছে ৯ হাজার ৬৬টি। এর মধ্যে ৫ হাজার গাড়িই পুরনো। জনবলের তুলনায় পুলিশের যানবাহনের সংখ্যা কম। শহরের চেয়ে মফস্বলের অবস্থা আরও করুণ। এ অবস্থায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর গাড়ি সংকট মেটাতে ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পুলিশ    সদর দফতর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার নতুন যানবাহন কেনার চাহিদাপত্র দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান সরকারই অবশ্য পুলিশের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থানায় যানবাহন ও আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা অপ্রতুল, উন্নত প্রশিক্ষণেরও অভাব। যানবাহন যা আছে তার তিন ভাগের দুই ভাগই নষ্ট। আরেক ভাগ যা আছে তাও লক্কড়-ঝক্কড়। এগুলো নিয়ে অভিযানে গিয়ে প্রায়ই উল্টো ধরা খেয়ে ফিরতে হয় পুলিশকে। অপ্রতুল আর পুষ্টিহীন খাবার, মানহীন খাকি ড্রেসের বিড়ম্বনা আর ডিউটির চাপে অনেকে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। আর তারা বেতন-ভাতা যা পান তা দিয়ে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ চলে না। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে অসত্ পথে পা বাড়ান। আর তখনই পড়ে যায় হৈচৈ— পুলিশের মতো খারাপ আর হয় না! এক বা একাধিক সদস্যের বদনামের ভাগি হতে হয় পুরো বাহিনীর সবাইকে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, দেশের ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্য বর্তমানে সারা দেশে পুলিশ বিভাগে কর্মরত আছেন ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৩৮ জন। বাংলাদেশে ১ হাজারের বেশি মানুষের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। অথচ ভারতে প্রতি ১৮৯ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন, পাকিস্তানে ৩৭৭ জনের বিপরীতে একজন, নেপালে ২১৯ জনে একজন, ভুটানে ১৪৬ জনে একজন, মালয়েশিয়ায় ২৪৯ জনে একজন, থাইল্যান্ডে ২২৮ জনে একজন, জাপানে ১৫৭ জনে একজন, যুক্তরাষ্ট্রে ২৪৫ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। পুলিশের জনবল না বাড়ালে জনগণকে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দেওয়া খুবই কঠিন। একাধিক কনস্টেবল, এএসআই ও এসআই জানান, তারা যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না। তবে রেশন পাওয়া যায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতোই। এডিসি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত যে আবাসন চাহিদা রয়েছে এর বিপরীতে আবাসন খুবই কম। সরকার মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা দিয়েছে। সবার পক্ষে বাড়ি ভাড়া করে থাকা সম্ভব নয়। সন্তানদের পড়ালেখা চালাতে হিমশিম খেতে হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার ভবনের এক কনস্টেবল জানান, অস্ত্রাগার ভবনটি অনেক পুরাতন ও জরাজীর্ণ। ভবনের নিচে রয়েছে অস্ত্রাগার। আর ওপরে রয়েছে ব্যারাক। সেখানে দেড় হাজার পুলিশ সদস্য গাদাগাদি করে থাকেন। ভবনটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে যেমন থাকার সমস্যা, তেমনি রয়েছে খাবার সমস্যাও। এখানকার খাবার খেয়ে প্রায়ই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, আবাসনের সমস্যা প্রকট। সারা দিন পরিশ্রম করে ট্রাফিক কনস্টেবলরা ঠিকমতো বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও পান না। কনস্টেবলরা ব্যারাকে মানবেতর জীবনযাপন করেন। খাবারের মানও ভালো নয়। এ ছাড়া নির্ধারিত জুতা পরে ডিউটি করায় বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যের পা সাদা হয়ে ঘা দেখা দিচ্ছে। ডিএমপি কন্ট্রোলের ২ নম্বর ব্যারাকের এক কনস্টেবল জানান, ৬ষ্ঠ তলা ভবনে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য গাদাগাদি করে থাকেন। রুম ছাড়াও বারান্দায় এবং নিচ তলা থেকে ৬ষ্ঠ তলায় ওঠার সিঁড়ির ফাঁকা জায়গাগুলোতে কনস্টেবলরা থাকছেন। এমনকি ওই ভবনের পেছনে তাবু টাঙিয়ে ফ্লোরিং করে পুলিশ সদস্যরা থাকছেন। রয়েছে খাবার পানি সংকট। কনস্টেবল থেকে শুরু করে অতিরিক্ত আইজিপি পর্যন্ত বিভিন্ন পদে আছেন নারী সদস্যরা। এর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। কয়েকজন নারী কনস্টেবল জানান, পুরুষের চেয়ে নারী সদস্যরা বেশি অবহেলিত। মাঝে মাঝে তারা নিজেরাই নির্যাতনের শিকার হন। এর পরও কিছু বলতে পারেন না। নারী পুলিশ সদস্যদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মাঠপর্যায়ে কাজ। একজন পুরুষ সদস্যকে জনগণ যেভাবে গ্রহণ করে, একজন নারী পুলিশকে সেভাবে গ্রহণ করে না। বিশেষ করে একটি থানায় যখন একজন নারী অফিসারের রাতে ডিউটি পড়ে তখন অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। বড় অফিসাররা এসব দেখেও না দেখার ভান করেন। টানা ১২-১৪ ঘণ্টা তাদের রাস্তায় ডিউটি করতে হয়। কিন্তু তাদের জন্য সেসব স্থানে পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা নেই। নারী ব্যারাকের অবস্থাও ভালো নয়। ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়, বাসস্থান, চিকিত্সা সুবিধা, পদোন্নতি, বেতন-ভাতা নিয়ে পুলিশ সদস্যরা নাখোশ। রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে চার কনস্টেবল মিলে একটি সিট পাচ্ছেন। ডিউটি করে আসার পর তারা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য খাতে পুলিশের বাজেট নেই বললেই চলে। চিকিত্সা বাবদ একজন কনস্টেবল মাসে পান ৪৪ টাকা, যা দিয়ে উন্নত চিকিত্সা করানো সম্ভব নয়। এ ছাড়া যানবাহন, অস্ত্র, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে; নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি তো আছেই। র‌্যাবের সব সদস্যকে মূল বেতনের ৭০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশকে ঝুঁকিভাতা দেওয়া হচ্ছে কম। বেতন-ভাতার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় বাড়িভাড়ায়। পদোন্নতির পরীক্ষায় অনেকে হয়রানির শিকারও হন। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের উদ্যোগ হিমাগারে পড়ে আছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরপর সে প্রক্রিয়া আর আগায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ১৮৬০ সালে গঠিত কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। পরে ১৯০২, ১৯৬০, ১৯৬৮, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালেও পুলিশ কমিশন গঠন করা হয়। ২০০৭ সালে কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। আইন সংস্কার না হওয়ায় পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। পুলিশের সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে আসতে হবে।

পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকার পুলিশের উন্নয়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছে। পুলিশের লজিস্টিক সাপোর্ট, জনবল ও যানবাহন বাড়ানোসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর পরও পুলিশের কিছু সমস্যা আছে। সেসব লাঘবের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে পুলিশ বাহিনীর জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

পুলিশ সপ্তাহ শুরু হচ্ছে আজ : বর্ণাঢ্য পুলিশ প্যারেডের মধ্য দিয়ে চার দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ-২০১৭ শুরু হচ্ছে আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন করবেন। পরে তিনি প্যারেড পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করবেন। সারা দেশের বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত ১৩টি কন্টিনজেন্টের প্রায় হাজার খানেক সদস্য প্যারেডে অংশ নেবেন। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন।

সেবা, সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য এবার পুলিশ পদক পাচ্ছেন ১৩২ জন পুলিশ সদস্য। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, এর মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) ২৬ জন, বিপিএম-সেবা ২৪ জন, প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) ৪১ জন এবং পিপিএম-সেবা পাচ্ছেন ৪১ জন পুলিশ সদস্য।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পুলিশের প্রশাসনিক কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, দীর্ঘদিনের আবাসন ও যানবাহন সংকট দূর, স্বতন্ত্র পুলিশ ডিভিশন গঠন, ঝুঁকিভাতার পরিধি বাড়ানোসহ ১৮টি দাবি তুলে ধরা হবে পুলিশ সপ্তাহে। দাবিনামার খসড়াও ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, এবারই প্রথম মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে দরবার করার কথা রয়েছে। দরবারে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের কনস্টেবল থেকে ডিআইজি পর্যন্ত মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিধি হিসেবে রাখা হবে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই দরবারে উপস্থিত থাকবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর