মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘরোয়া সভায় বন্দী বিএনপি

কোথাও নেই শৃঙ্খলা ত্যাগী যোগ্যরা মূল্যায়ন পাচ্ছেন না

শফিউল আলম দোলন

ঘরোয়া সভায় বন্দী বিএনপি

সারা দেশেই অন্তর্দ্বন্দ্বের আগুনে পুড়ছে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত দলে কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। ত্যাগী, যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের অবমূল্যায়নই এখন দলটির অঘোষিত নীতি।

দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কৌশলে দূরে ঠেলে একশ্রেণির সুবিধাবাদী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিভিন্ন মহল থেকে নানা সুবিধা নিয়ে তারা আখের গোছাতে ব্যস্ত। দলীয় কর্মসূচিতে মাঠে না নেমে বাসার আশপাশ থেকে অনেকে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলে পাঠান দলের নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়ে।

পাশাপাশি বিএনপির তৃণমূলেও দুরবস্থা চলছে। ফলে আন্দোলনের নানা ইস্যু থাকলেও মাঠের কর্মসূচিতে সফল হচ্ছে না দলটি। অনেকটা ঘরে বসেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরীর নেতা-কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঘরকুনো। সংবাদ সম্মেলন আর ঘরোয়া সভা-সমাবেশের বৃত্তেই বিএনপি বন্দী হয়ে পড়ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

গত ১ জানুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক ছাত্রসমাবেশে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলীয় নেতা-কর্মীদের ধমক দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই— এ ধরনের স্লোগান যেন আর না দেওয়া হয়। এই অর্থহীন স্লোগান আর তিনি শুনতে চান না। কারণ গত কয়েক বছরে ঢাকার কোনো নেতা-কর্মীকে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে রাজপথে নামতে দেখেননি তিনি। কাজেই পারলে রাজপথে নেমে দেখান, অন্যথায় শুধু তাকে (খালেদা জিয়াকে) খুশি করার জন্য ঘরের ভিতরে বসে তার সামনে এই স্লোগান দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেন বিএনপিপ্রধান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে গুম, হত্যা, নির্যাতন ছাড়াও অসংখ্য মামলায় গ্রেফতার, রিমান্ডসহ গণহারে কারানির্যাতনের শিকার তৃণমূল নেতারা। তারা কেন্দ্র থেকেও পাচ্ছেন বঞ্চনা, অবহেলা আর অবমূল্যায়ন। অনেকে ছিটকে পড়ছেন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নতুন কমিটি থেকেও। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মোটা অঙ্কের অর্থ আর নানা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নিচ্ছেন অযোগ্য ও সুবিধাবাদী প্রকৃতির ব্যক্তিবর্গ। ফলে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। দল গোছানোর নামে দলের কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতা যা খুশি তা করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন থেকে শুরু করে উপজেলা, ইউপি, পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। গত ইউপি নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক পর্যায়ের এক নেতার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি টাকা থাকার সংবাদ এসেছে পত্রপত্রিকায়। দলীয় মনোনয়ন বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সর্বত্র বাণিজ্য চলছে। ফলে এখন আর আগের মতো দলীয় কর্মসূচি পালন হয় না।

এ পরিস্থিতিতে ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছেন তৃণমূল নেতারা। ঢাকায় এত দিন থানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামলেও কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতার বিতর্কিত ভূমিকায় তারাও এখন মাঠে নামার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। দেশের প্রতি জেলা-উপজেলায় বিএনপিতে একই চিত্র। এ প্রসঙ্গে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপি নেতাদের পাণ্ডিত্য পরিহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু দলীয় কার্যালয়ে বসে প্রেস ব্রিফিং করে বড় বড় বক্তৃতা আর সভা-সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতির আশায় বসে থাকলে হবে না। দলকে ক্ষমতায় আনতে হলে সবাইকে মাঠে নামতে হবে। তিনি শিমুল বিশ্বাসের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য একজন মহিলা বিশেষ সহকারী নিয়োগের পক্ষে মত দেন। দলের সাংগঠনিক দেউলিয়াত্ব প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, বিএনপি নেতাদের দেখলে মানুষ এখন টিটকারি দেয়। বলে যে, একটা সমাবেশ করারও মুরোদ নেই যাদের, তাদের দিয়ে কিছু হবে না। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ বিএনপির কাছ থেকেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নেতৃত্ব আশা করে। সে হিসেবে আমরা ব্যর্থ। যে কোনো মূল্যে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে।’ গত বছর ৬ আগস্ট দলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের পর দেশের মাত্র দুটি জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন ও কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বদলে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ ও জামালপুর জেলা বিএনপির সম্মেলনের এক সপ্তাহ পর ঢাকার নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির নবনিযুক্ত সভাপতি ও জামালপুর জেলা বিএনপির নতুন সাধারণ সম্পাদক দুজনই দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। এতে লঙ্ঘিত হয়েছে গঠনতন্ত্রে থাকা ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি।

৩০ অক্টোবর গুলশান কার্যালয়ের জনৈক কর্মকর্তার সংবাদপত্রে প্রকাশিত বক্তৃতায় দেখা যায়, বিএনপিতে এখন আর কোনো যোগ্য ও সাহসী নেতা অবশিষ্ট নেই। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ডাকেও এখন আর দলের কোনো নেতা-কর্মী মাঠে নামেন না। এ প্রসঙ্গে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের এ পরিস্থিতির জন্য শতভাগ দায়ী গুলশান কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তা। এদের একজন বসেন নিচতলায়, আরেকজন দোতলায়। এখতিয়ার না থাকলেও তারা এখন পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দেন, দল ও দলের শীর্ষ নেতাদের হেয় প্রতিপন্ন করেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির ৫০২ জনসহ চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কমিটির আরও প্রায় ১০০ সদস্যের মধ্যে হাতে গোনা দু-চার জন ছাড়া তেমন কাউকেই এখন আর মাঠে-ঘাটে দেখা যায় না। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যারা অর্থের বিনিময়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন, তারা নৈতিকভাবে বিএনপির জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে একটুও আগ্রহী নন। তবে এ পরিস্থিতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হতাশ নন। তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও নাজুক রাজনৈতিক অবস্থার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের দমন-নীতিকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, দেশব্যাপী এত গুম, হত্যা, জুলুম-নির্যাতনের পরও যে বিএনপি নেতা-কর্মীরা টিকে আছেন, এজন্য সবাইকে ধন্যবাদ। তিনি বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে আমাদের আন্দোলন ব্যর্থ মনে হলেও শিগগিরই আমরা রাজপথে নামব।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর