মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

হেফাজতে মৃত্যু আইন বাতিল চায় পুলিশ

প্রথম দরবার হলে যা হল

সাখাওয়াত কাওসার

বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে প্রথম দরবার (কল্যাণ প্যারেড)। আর এই দরবারেই উপস্থিত থাকলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের মুখেই বললেন, কোনো প্যারেড অনুষ্ঠানে এত বেশি সময় মনে হয় আপনাদের দিয়েছি। সকাল ৯টা ৫৮ মিনিট থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত প্যারেড অনুষ্ঠানে থাকার পর পৌনে ১টা থেকে বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পুলিশের কল্যাণ প্যারেডে উপস্থিত থেকে তাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিকাল পৌনে ৩টা পর্যন্ত তিনি কাটিয়েছেন পুলিশের সঙ্গে।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল চেয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। এ আইনের কারণে অনেকেই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের সুযোগ পাচ্ছেন বলেও দাবি করেন তারা। পুলিশ কর্মকর্তাদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বেসরকারি বিল হিসেবে সংসদে এ আইন পাস হয়েছে। তাই এ মুহূর্তে এ আইন বাতিল করা যাবে না। তবে কেউ যদি মিথ্যা মামলা দায়ের করে সে ক্ষেত্রে তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন শেষে সোমবার দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের শহীদ এসআই সিরু মিয়া মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত কল্যাণ প্যারেডে (দরবার) পুলিশ সদস্যরা এ আইন বাতিল ছাড়াও তাদের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। পুলিশের সব ধরনের সমস্যা ও দাবির বিষয়ে অবহিত আছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো দাবি জানাতে হবে না। পর্যায়ক্রমে পুলিশের সব সমস্যার সমাধান করা হবে। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তানভীর সালেহীন ইমন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন কিংবা মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার বিধান রেখে একটি বেসরকারি বিলের মাধ্যমে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন নামে একটি আইন করা হয়েছে। আইনটিতে নির্যাতনের সংজ্ঞায় মানসিক কষ্টকে নির্যাতন বলা হলেও তা নির্ণয়ে কোনো মানদণ্ড না থাকায় যে কেউ এ আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার সুযোগ পাচ্ছে। তানভীর সালেহীন আরও বলেন, ‘মহামান্য সুপ্রিম কোর্টেও আপিল বিভাগের এক রায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে যে কোনো নির্যাতনের অভিযোগে তদন্ত্ত ব্যতিরেকে আবশ্যিকভাবে এ আইনের অধীনে তদন্তকারী কর্মকর্তা, অফিসার ইনচার্জ বা কমান্ডিং অফিসারের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো মামলা নেওয়ার জন্য বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ আইনে একাধিক থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিসহ দেশে প্রচলিত অন্যান্য আইন যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যকে দায়িত্ব পালনে সুরক্ষা প্রদান করেছে সেখানে তার অধিকারকে খর্ব করেছে। পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মানসিক নির্যাতনের অজুহাতে যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করার সুযোগ থাকে তবে তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পুলিশ নিরুৎসাহিত হবে। ফলে মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে পুলিশের প্রচেষ্টায় ভাটা পড়বে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনটি বজায় থাকলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের কর্মস্পৃহা হারাবে। ফলে রাষ্ট্রীয় ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।’ এ ছাড়াও পুলিশের কনস্টেবল খায়রুন্নাহার, এএসআই তাপস কুমার ঘোষ, সার্জেন্ট মশিউর রহমান, এসআই সুজন কুমার কুণ্ডু, ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে থানাসহ বিভিন্নস্থানে আবাসন সমস্যা, ঝুঁকিভাতা, পোশাক-পরিচ্ছদসহ বিভিন্ন সমস্যা। আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম এ কল্যাণ প্যারেডে (দরবার) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছাড়াও বেশ ক’জন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাগণ এবং পুলিশ ও র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো প্যারেড অনুষ্ঠানে এত বেশি সময় আমি মনে হয় আপনাদের সঙ্গেই দিয়েছি। তবে ভালো হয়েছে যে, আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আসার পর আমি সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি। আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেখানে শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, স্বাধীন দেশ পরিচালনার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কি অবস্থা তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তাদের সমস্যাগলো কোথায় কি সেগুলো আমার জানা আছে।  তিনি বলেন, আমি যখনই সরকারে এসেছি, আমার কাছে কিন্তু কখনো কিছু চাইতে হয় নাই।  পুলিশকে দেওয়া নানা সুবিধার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সাল আমরা দেখেছি পুলিশের বাজেট মাত্র ৩৬০ বা ৪০০ কোটি টাকার বাজেট। আমরা একধাপে ঐ বছর সেটা দ্বিগুণ করে দেই। যাদের দিয়ে আমরা কাজ করাব তাদের ভালো মন্দ দেখা আমাদের দায়িত্ব।  শেখ হাসিনা বলেন, এখন থেকে আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আর শ্রেণিবিন্যাস থাকবে না। গ্রেডভুক্ত হয়ে কাজ করবে। মর্যাদা নিয়ে থাকবে। আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে। পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে। সেটা বিবেচনা করেই আমরা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট করেছি। টুরিস্ট পুলিশ করেছি। তাদের জন্য বিশেষায়িত ট্রেনিং দরকার। যানবাহনের প্রয়োজন। এগুলো আমাদের মাথায় আছে। সেভাবেই আমরা করছি। স্পেশাল প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন, নৌপুলিশ আমরা করেছি। পর্যায়ক্রমে আমরা সব সুবিধা নিশ্চিত করব। নারী কনস্টেবল খায়রুন্নাহারের পোশাক সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয় দুই সেট কাপড় কখনো চলে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র সচিব এ ব্যাপারে ইমিডিয়েটলি ব্যবস্থা নেবেন। আমিও চাই আমার পুলিশ যখন ডিউটি করবে স্মার্টলিই করবে। সেভাবেই সে চলবে। নিশ্চয়ই নোংরা কাপড়-চোপড় পরে সে ডিউটি করবে না। আবাসন সমস্যার বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন। আমার কাছে কেউ দাবি করেনি। তবে আবাসনের ব্যাপার আমাদের চিন্তা ভাবনা আছে কোনো এলাকায় আরও বেশি জায়গা নিয়ে আরও দুইটা তিনটা ব্যারাক তৈরি করতে পারি। নতুন নতুন স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলছি। সেগুলো বিবেচনা করে আমরা তা করব। স্টাফ কোয়ার্টার, ডরমেটরি তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা আমার আছে। হাসপাতালের বিষয়ে তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে একটা সার্ভে আমরা করেছি। আমাদের সব সরকারি এবং অন্য যে কোনো হাসপাতালে পুলিশের যদি কেউ আহত হয় জরুরি প্রয়োজন হয়, সেখানে যাতে পুলিশের জন্য আলাদা সিট থাকে সেই ব্যবস্থা আমি করব। সহকারী পুলিশ সুপার তানভীর সালেহিন ইমনের এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ আইনটা পার্লামেন্টে পাস হওয়া বেসরকারি বিল। যিনি বিলটা নিয়ে আসছেন তিনি একজন নির্যাতিত। বিএনপির আমলে তাকে তুলে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। পাস হওয়া বেসরকারি বিল বাতিল করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না জানি না তবে মিথ্যে মামলা যদি কেউ করেন সে কিন্তু সমান পর্যায়ে শাস্তি পাবেন। তবে হাই কোর্টের একটা রায় রয়েছে। তবে মিথ্যে মামলা কখনো গ্রহণযোগ্য না। দরবারে উপস্থিত সবার উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,  পুলিশের হাত-পা যদি বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে তারা কাজ করবে কিভাবে। ১০টা ভালো কাজ করলে দু-একটা ভুল হতে পারে। মানুষই তো ভুল করে। ভুল করে না শয়তান। যেহেতু হাই কোর্টের রায় তাই কিছু বলতে পারি না। আমাদের হাত-পা মুখ বাঁধা। দরবারের শুরুতে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, গত ৮ বছরে আপনার সরকার আমলে পুলিশ বাহিনীর সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নের কথা পুলিশের সব সদস্য অবগত রয়েছেন। ঝুঁকিভাতা এবং রেশনসহ নানা ধরনের সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর