বুধবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
পঞ্চগড়ের হাসপাতাল

চিকিৎসকের চেয়ে বেশি রিপ্রেজেনটেটিভ

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, পঞ্চগড় থেকে

চিকিৎসকের চেয়ে বেশি রিপ্রেজেনটেটিভ

সকাল সাড়ে ১০টা। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল। দোতলায় মহিলা ওয়ার্ডে একজন চিকিৎসক রোগী দেখছেন। তার আশপাশে ছিলেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন রিপ্রেজেনটেটিভ। রোগীকে কী ওষুধ লিখে দেওয়া হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। ওই চিকিৎসক যতক্ষণ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছিলেন, ততক্ষণই দেখা যায় তাদের। শুধু চিকিৎসকের কাছেই নয়, হাসপাতালজুড়েই ছিল রিপ্রেজেনটেটিভের ছড়াছড়ি। এ ঘটনা গতকালের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ৩৬টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ২৬টি। ১০ জন চিকিৎসক থাকলেও ছুটি আর প্রশিক্ষণে থাকেন অর্ধেকেরও বেশি। একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া কোনো বিভাগেই নেই বিশেষজ্ঞ। আলট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে মেশিন পুরোপুরি অকেজো। কয়েকজন রোগী অবশ্য অভিযোগ করলেন, ইচ্ছা করেই এসব যন্ত্রপাতি অকেজো করে রাখা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো যাতে রমরমা বাণিজ্য করতে পারে। পঞ্চগড় সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট পাঁচটি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল ছাড়া অন্যগুলো হলো তেঁতুলিয়া, আটোয়ারি, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। জেলায় মোট চিকিৎসকের পদ ১৬৮। কর্মরত আছেন ৪৮ জন। ১২০টি পদ শূন্য। জেলায় মোট এক্স-রে মেশিন ৭টি। এর ৫টিই অচল। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ১১টি। ৬টিই অচল। তেঁতুলিয়ায় চিকিৎসকের পদ ২৮টি। কর্মরত মাত্র চারজন। একজন ছুটিতে। বাকি তিনজনই অন্য জেলায় যেতে লবিং-তদবিরে ব্যস্ত। কাগজে-কলমে অবশ্য আটজনের নাম উল্লেখ থাকলেও বোদা হাসপাতালে কর্মরত মাত্র একজন। আটোয়ারিতে পদের সংখ্যা ২৬, রয়েছেন মাত্র পাঁচজন চিকিৎসক। এর মধ্যে তিনজনই থাকেন নিয়মিত ছুটিতে। দেবীগঞ্জে ৩১ জনের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১০ জন চিকিৎসক। ছুটি আর প্রশিক্ষণে প্রতিনিয়ত কর্মস্থলে অর্ধেকই অনুপস্থিত থাকেন। পাঁচটি হাসপাতালে নার্সের পদ ১৪২টি। কর্মরত রয়েছেন ১১১ জন।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. পীতাম্বর রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চিকিৎসকের শূন্যপদগুলো পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। ক্লিনার সংকট আছে। রিপ্রেজেনটেটিভদের দৌরাত্ম্য আগে অনেক বেশি ছিল। আমি অফিস চলাকালে তা শূন্যের কোঠায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’ পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজিউর রহমান রাজু বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতা কর্মী অপ্রতুল। বাইরে থেকে ধার করা কর্মী দিয়ে হাসপাতালগুলো পরিষ্কার করানো হয়। তাদের বেশি কিছু বলা যায় না। কারণ তারা নিয়োগপ্রাপ্ত নন।’ রিপ্রেজেনটেটিভদের উৎপাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যেই তাদের হাসপাতাল থেকে বের করে দিই। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়ায় আবারও তারা হাসপাতালে ভিড় করেন।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চগড়ে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির অন্তত ৫০০ রিপ্রেজেনটেটিভ জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়ান প্রতিনিয়ত। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের আউটডোরে রোগী দেখার সময় রিপ্রেজেনটেটিভের ভিড়ে রোগীরা বিরক্ত। অনেক সময় রোগীর পরিবারের সদস্যদের হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে তারা নিজেদের কোম্পানির ওষুধ কিনতে উৎসাহিত করেন।

পাঁচটি হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ওয়ার্ড ও জরুরি বিভাগ নোংরা, আবর্জনাপূর্ণ। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। বাথরুম ও টয়লেট দুর্গন্ধময়। এগুলো দেখার কেউ নেই। পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালের মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বিছানার চাদর আছে বালিশ নেই, বালিশ আছে তো চাদর নেই। যেগুলো রয়েছে সব নোংরা। নার্সদের দুর্ব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হাসপাতালে ভর্তি ফি সরকার নির্ধারিত ৫ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে ২০-৩০ টাকা। হাসপাতালের ভিতরে বাইরে দালাল চক্রও দেখা যায়। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে, কেউ কেউ ক্লিনিকগুলোয় রোগী ভাগিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন। শিশু ওয়ার্ডে ১০ মাস বয়সী শামীম নামের এক রোগীর মা হাজেরা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার সন্তানের শরীরে কলেরা স্যালাইন পুশ করতে গিয়ে দুজন নার্স অন্তত ২০টি স্থানে ক্ষত করেন। তার পরও তারা ঠিকভাবে স্যালাইন পুশ করতে পারেননি। শেষে বাইরে থেকে একজনকে ৫০ টাকা দিয়ে স্যালাইন পুশ করানো হয়। শিশু ওয়ার্ডের আরেক রোগীর বাবা অভিযোগ করেন, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নানা সমস্যা। প্রায় দুই লাখ মানুষের একমাত্র হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে এক্স-রে মেশিন বিকল রয়েছে। চিকিৎসকরা রোগীদের স্থানান্তর করেন কাছের একটি বেসরকারি প্যাথলজিতে। সেখান থেকে চিকিৎসকরা মোটা অঙ্কের বকশিশ পান বলে অভিযোগ। নেই আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনও। সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রসূতিদের। প্রসবকালীন হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও গাইনি চিকিৎসক না থাকায় তাদের স্থানান্তর করা হয় বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে। ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে রোগীদের বাইরে থেকেই ওষুধপত্র আনতে হয়। সরকারি কোনো ওষুধ সরবরাহ পান না তারা। রিপ্রেজেনটেটিভদের উৎপাতও বেশি। সাধারণ রোগীদেরও দায়িত্ব নিতে চান না চিকিৎসকরা। রেফার্ড করেন বেসরকারি হাসপাতালগুলোয়। সেখান থেকেও তারা পান আর্থিক সুবিধা। বোদা উপজেলায় একজন মাত্র চিকিৎসক দিয়েই খুঁড়িয়ে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। আশপাশের তিনটি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সব সময় থাকে রোগীর ভিড়। কিন্তু একমাত্র চিকিৎসকের পক্ষে এসব রোগীর সঠিকভাবে সেবাদান করা সম্ভব হয় না। ওই চিকিৎসকই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন ছাড়াও আবাসিক ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।

সর্বশেষ খবর