শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

১২ বছরেও বিচার হলো না কিবরিয়া হত্যা মামলার

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

১২ বছরেও বিচার হলো না কিবরিয়া হত্যা মামলার

ছাত্রজীবনে  ছিলেন অদম্য মেধাবী। পেশাগত জীবনে ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে। রাজনীতিরও শুরু শীর্ষ থেকেই। জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে চেষ্টা করতেন সবার পাশে থাকার। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি শীতের বিকালে তিনি এসেছিলেন প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। কিন্তু নির্মম গ্রেনেড হামলায় সেই সূর্যসন্তান শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে চলে যেতে হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে। আজ থেকে ১২ বছর আগের এই বেদনাবিদূর ঘটনা এখনো নাড়া দেয় সবাইকে। আলোচিত বৈদ্যের বাজার ট্যাজেডির কথা ভুলতে পারেনি কেউ। সেদিনের নির্মম হামলায় আহতরা এখনো কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় কিবরিয়া পরিবারসহ হতাহতদের পরিবার এখন হতাশ। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ-পরবর্তী এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। সেদিন তার জনসভা ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বক্তব্য শেষে যখন তিনি মঞ্চ থেকে নেমে সহকর্মীদের নিয়ে বৈদ্যের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেটে আসেন তখনই দিনের আলো নিভে প্রায় সন্ধ্যা। হঠাৎ করেই বিকট শব্দ। হুড়োহুড়িতে চারদিকে গগনবিদারী চিৎকার। আর্জেস গ্রেনেডের ওই হামলায় সেদিন প্রাণ হারান জনপ্রিয় নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ তার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দীক আলী। আহত হন কমপক্ষে ৭০ জন নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পরদিন ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু মামলাটির স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে দলীয় বিবেচনায় পরিচালিত হতে থাকে। সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলা তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে তৎকালীন জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, জেলা বিএনপির কর্মী ও ব্যাংক কর্মকর্তা আয়াত আলী, কাজল মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহ-দফতর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জিয়া স্মৃতি গবেষণা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী, বিএনপি কর্মী তাজুল ইসলাম, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জমির আলী, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন মোমিন ও ছাত্রদল কর্মী মহিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়।

অভিযোগপত্র দেওয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি আবেদন করেন। এক পর্যায়ে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে এই আলোচিত মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুত্ফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল।

সম্পূরক চার্জশিটে প্রথম ১০ জনের বাইরে অভিযুক্তরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, লস্কর-ই-তৈয়বা সদস্য আবদুল মজিদ কাশ্মীরি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মহিউদ্দিন অভি, শাহেদুল আলম দিলু, সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ, ফজলুল আলম মিজান, মিজানুর রহমান মিঠু, মোহাম্মদ আবদুল হাই, মোহাম্মদ আলী, মুফতি সফিকুর রহমান, বদরুল এনায়েত মো. বদরুল, বদরুল আলম মিজান।

২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশিটের ওপর হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল আদালতে নারাজি আবেদন করেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।

২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিলেট অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্তর্ভুক্ত আসামিরা হলেন সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি তাজউদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। একই সঙ্গে পূর্বের চার্জশিটভুক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আবদুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। এদিকে ২১ ডিসেম্বর সংশোধিত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। একই সঙ্গে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেওয়া হয়। ২৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ৩৫ জনকে আসামি ও ১৭১ জনকে সাক্ষী করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা পারুল।

হত্যা মামলাটি সিলেটের দ্রুত বিচার আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিস্ফোরক মামলাটিও বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডিতে অনেকই এখনো পঙ্গু অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। সেই ভয়াল স্মৃতি এখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির এমপি বলেন, আমি বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হলেও এখনো আমার গায়ে গ্রেনেডের শত শত স্প্লিন্টার। পায়ে স্টিল লাগানো।

গ্রেনেড হামলায় নিহত আবদুর রহিমের স্ত্রী আফিয়া খাতুন জানান, তিনি সরকারের কাছে কিছুই চান না। মৃত্যুর আগে তার স্বামী হত্যার বিচার দেখে যেতে চান। নিহত ছিদ্দিক আলীর ছেলে কুদ্দুছ মিয়া জানান, বিচার কাজ শুরু হলেও কবে শেষ হবে এ নিয়ে তার পরিবার হতাশ।

শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া বর্তমানে বিদেশে আছেন। তবে তার আমেরিকা প্রবাসী মেয়ে অধ্যাপক ড. নাজলী কিবরিয়া দেশে এসেছেন। তিনিও মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানান।

মৃত্যুবার্ষিকীতে কর্মসূচি : কিবরিয়ার ১২তম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা ও হবিগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বৈদ্যের বাজারের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শোক র‌্যালি, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা। পৃথকভাবে এ কর্মসূচিগুলো পালন করবে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন এবং কিবরিয়া স্মৃতি সংসদ। এ ছাড়া ঢাকায় মরহুমের গোরস্থানে সকাল ৯টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে কিবরিয়া পরিবার।

সর্বশেষ খবর