রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফের মামলার চাপে খালেদা-তারেক

শফিউল আলম দোলন

ফের মামলার চাপে খালেদা-তারেক

আবারও মামলার চাপ বেড়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। দ্রুত এগোচ্ছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ দুর্নীতি ও নাশকতা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার কার্যক্রম। গত বুধবারও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতে হাজির না হওয়ায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত। একই মামলায় আগামী ৩০ জানুয়ারি হাজির না হলে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ঘোষণা দিয়েছেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদ্দার। দলের নীতিনির্ধারণী মহলের সদস্যদের ধারণা, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য অবস্থা করার লক্ষ্যেই এসব মামলা নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে সরকার।

এর আগে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি নাশকতাসহ বেশ কয়েকটি মামলার চার্জশিট প্রদান ও সাক্ষ্যগ্রহণের কাজ শেষ করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় সব মামলার কার্যক্রমই সচল রয়েছে। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মোট ১৫টি এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ৫টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া এসব তথ্য জানান। এসব মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। কেউ বলছেন, উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার হলে কোনো মামলাই টিকবে না। কারণ সব মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার মতো সাজা হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলাসহ দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো যে দ্রুত গতিতে চলছে, তাতে সিনিয়র নেতারা আশঙ্কা করছেন যে— বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার জন্যই মামলাগুলো দ্রুত করা হচ্ছে। বিচারে শীর্ষ এই দুই নেতার ‘সাজা’ হলে দল কীভাবে চলবে, তা নিয়েও হাজারো প্রশ্ন বিএনপির ঘরে-বাইরে। এরই মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই দুই মামলায় মা ও ছেলের বিরুদ্ধে রায় হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তাদের আইনজীবীরা। এ দুই মামলাতেই খালেদা জিয়া প্রধান আসামি। একটিতে রয়েছেন তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপি প্রধানের বিরুদ্ধে গ্যাটকো ও নাইকো দুর্নীতি মামলাও চলছে। চাঞ্চল্যকর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাও চলছে দ্রুতগতিতে। ওই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমানের নাম যুক্ত করা হয়েছে।  জানা গেছে, এর আগে রাজধানীর দারুস সালাম থানায় নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনসহ ৫১ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। এই দুই মামলার অভিযোগপত্রে খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে অবরোধের মধ্যে নাশকতার মামলায় হুকুমের আসামি করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ৬ ও ১৯ মে যাত্রাবাড়ী থানার দুটি মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। একই বছরের ৩ মার্চ গাবতলী এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলায় এসআই শহীদুর রহমান অভিযোগপত্র দেন। এতে খালেদা জিয়াসহ মোট ২৭ জনকে আসামি করা হয়। আর ৪ ফেব্রুয়ারি মিরপুর শাহআলী মাজারের পাশে কাঁচাবাজারে একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায় অভিযোগপত্র দেন এসআই আবদুর রাজ্জাক। এতে আসামি করা হয় খালেদা জিয়াসহ মোট ২৪ জনকে।  ড্যান্ডি ডাইয়িং ঋণখেলাপি মামলার কার্যক্রমও চলছে দ্রুতগতিতে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা স্থগিত চেয়ে খালেদা জিয়ার করা আবেদনের শুনানি শেষে তা খারিজ করে দিয়েছে হাই কোর্ট। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ছয়টি এবং হত্যা, বিস্ফোরক ও নাশকতার অভিযোগে চারটিসহ মানহানি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ মিলিয়ে মোট ১৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুদকের করা জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিএনপির এই দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও দলের যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপকালে তারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য যা কিছু করা দরকার, তার সবকিছুই করছে। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের রাজনৈতিক মামলায় সাজা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার ফন্দিও থাকতে পারে। কিন্তু এসব নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত নই। কারণ জেল খাটার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, ম্যাডামেরও আছে। ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ সময়ই তিনি জেল খেটে ফেলেছেন। কাজেই আমাদের আর জেলের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। এতে বরং ভোটবিহীন নির্বাচনে গঠিত সরকারের স্বরূপ পুরোটাই উন্মোচিত হবে। আসলে এসব মোকাবিলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমাদের মামলা-হামলা আর জেলের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। নেত্রীও জেল খেটেছেন, আমরাও জেল খেটেছি। আর মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করবে, করুক। এরও বোধ হয় খুব বেশি প্রয়োজন হবে না। কারণ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া এই সরকারের অধীনে আমরা এমনিতেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাব না। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের মতে, ন্যায়বিচার পেলে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো মামলাই টিকবে না। কিন্তু আমরা ন্যায়বিচার পাব কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন— উদাহরণ হিসেবে নাইকো মামলার কথা বলা যায়, নাইকো দুর্নীতির একই অভিযোগে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলা চলছে। একইভাবে তারেক রহমানের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহু চেষ্টা করেও এ মামলায় তারেক রহমানকে জড়াতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার সম্পূরক অভিযোগপত্রে তার নাম জড়িয়েছে। এ মামলার মূল আসামি মুফতি হান্নানও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে তারেক রহমানের নাম উল্লেখ করেননি। প্রশ্নবিদ্ধ এসব মামলায় সরকার খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে সাজা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করলে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে।

ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে মামলা করা হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব নিয়ে একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মোটেও চিন্তিত নই। কারণ আদালতে যদি সঠিক বিচার হয়, তবে এসব মামলা একটিও টিকবে না। কারণ যে অভিযোগে এগুলো দায়ের করা হয়েছে তার একটিরও কোনো ভিত্তি নেই। এ মামলার প্রায় সবগুলোরই বাদী ও সাক্ষী সবই হলো— আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। হয়তো নির্বাচনে তাদের অযোগ্য ঘোষণার উদ্দেশ্যও হতে পারে। কিন্তু তাতেও শেষ পর্যন্ত সরকারের খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট গৌতম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করতেই মিথ্যা অভিযোগ এনে এসব রাজনৈতিক মামলা সাজানো হয়েছে। বিএনপির ভিতরে ‘মাইনাস-টু’ কার্যকর করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা এতে সফল হবে না। জানা যায়, শুধু জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধেই ৭৫টি মামলা রয়েছে। অবশ্য একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ১৯টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও রয়েছে অন্তত অর্ধশত মামলা। এ ছাড়াও সারা দেশে ২০ হাজারেরও বেশি মামলায় আসামি রয়েছেন পাঁচ লক্ষাধিক বিএনপি নেতা-কর্মী। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৮৮টি মামলার আসামি হয়ে সব মামলায় জামিনে আছেন।

সর্বশেষ খবর