মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রস্তাব অরাজনৈতিক ব্যক্তির

বিশিষ্টজনের সঙ্গে সার্চ কমিটির বৈঠক । কথা হবে আরও পাঁচজনের সঙ্গে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রস্তাব অরাজনৈতিক ব্যক্তির

সার্চ কমিটির সঙ্গে গতকাল ১২ বিশিষ্ট নাগরিকের বৈঠক হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সৎ, গ্রহণযোগ্য ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। সার্চ কমিটির সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এমন পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া দুই মাস কমিশন শূন্য থাকলেও ইসি গঠনের একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কথাও বলেছেন অনেকে। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সার্চ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে ২ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয় বিশিষ্টজনদের। কমিটির প্রধান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে বিকাল সোয়া ৪টায় বৈঠক শুরু হয়, চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।

দ্বিতীয় দফায় মতবিনিময়ের জন্য আরও পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সার্চ কমিটি। ১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় তাদের সঙ্গে বসবেন কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে কমিটির কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর নাম জমা দেওয়ার সময় বেড়েছে ৪ ঘণ্টা। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসি গঠন নিয়ে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩১টি রাজনৈতিক দল আজ বিকাল ৩টা পর্যন্ত পাঁচজন করে নাম প্রস্তাব করতে পারবে। কমিটির আমন্ত্রণে হাই কোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম?্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ ও আইনজীবী সুলতানা কামাল এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন (অব.), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. তোফায়েল আহমেদ, সুশাসনের জন?্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা এ আলোচনায় অংশ নেন। এ ছাড়া অনেকে সার্চ কমিটির কাছে লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছেন। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘বিশিষ্টজনরা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো রেকর্ড নিয়েছি। তারা প্রত্যেকেই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সৎ, দক্ষ, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের বাছাই করার পরামর্শ দিয়েছেন।’ ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির কার্যক্রমে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ বিভাগের সচিব সার্চ কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। এর মধ্যে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা প্রস্তাব করেছি, যাদের মধ্যে দেশপ্রেম আছে, স্বাধীনতার মূল্যবোধ আছে, যারা ত্যাগ-তিতিক্ষার নজির রেখেছেন এবং সৎ, দক্ষ লোকদের বাছাই করতে বলেছি।’ ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেছেন, ‘কারও নাম চায়নি সার্চ কমিটি। অরাজনৈতিক ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সব মানুষের একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকে। সেটায় কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু অতীতের ছাত্রজীবনে হোক বা কর্মজীবনে হোক সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। আমরা সবাই বলেছি এমন একটা কমিশনের প্রস্তাব করা উচিত হবে যেটা প্রাথমিকভাবে মানুষের মধ্যে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানুষের আস্থা না এলে সেই কমিশনের কাজ করা কঠিন হবে। এই কমিশনের জন্য এমন লোক বাছাই করা উচিত যারা এই পদের জন্য যোগ্য, যোগ্যতাসম্পন্ন। নিম্ন যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না।’ এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘ইসি গঠনের কিছু মানদণ্ড তুলে ধরেছি। এমন লোককে নির্বাচন করতে হবে যাকে দেখে মানুষ প্রথমেই বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন, নিরপেক্ষ বিবেচিত ব্যক্তিদের বাছাই করতে হবে। আশা করি, সার্চ কমিটি নতুন ইসি গঠনে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করবে।’ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘সংবিধানে যে কথা বলা হয়েছে, তার আলোকে কথা হয়েছে। কী কী গুণ থাকা উচিত, অনেকেই বিস্তারিত বলেছেন। আমরা কেউ কেউ বলেছি, আইন প্রণয়নের সুযোগ এখনো আছে। যদি এক মাস অথবা দুই মাস কমিশন শূন্য থাকে তবুও কোনো সমস্যা হবে না। এখন দেশে কোনো নির্বাচন নেই। আইন করা দরকার।’ অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে কিছু পদ্ধতিগত বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। আমরা সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। নির্বাচন ভণ্ডুল নির্বাচন কমিশনও করে না, সার্চ কমিটিও করবে না। নির্বাচন যদি অস্বচ্ছ হয়, অন্যরকম হয় তার জন্য মূলত দায়ী থাকে রাজনৈতিক দলগুলো এবং আমাদের নিজেদের, জনগণের যে দৃঢ়তা, জনগণের যে অঙ্গীকার নির্বাচন সুষ্ঠু করার সেখানে যদি ঘাটতি থাকে তখনই নির্বাচন ভণ্ডুল হয়।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘ইসি গঠনের একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা উচিত। সময় লাগলেও আইন করে নতুন ইসি নিয়োগ দেওয়া উচিত হবে।’ জানা গেছে, লিখিত প্রস্তাবে সুজন সম্পাদক বলেছেন, ‘অধিকাংশ দলই সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ আমাদের চোখে পড়েনি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ব্যাপারে আইন প্রণয়ন না করার কারণেই এরই মধ্যে অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আপনাদের কমিটির আইন ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করছি। রাষ্ট্রপতি তার সুপারিশে যোগ্যতার একটিমাত্র মানদণ্ডই নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তা হলো যে, কমিশনারদের মধ্যে অবশ্যই একজনকে নারী হতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের যোগ্যতার মানদণ্ড সম্পর্কে ২৫ জানুয়ারি জারি করা প্রজ্ঞাপনে কিছুই বলা নেই।’ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটি কিছু নাগরিকের সঙ্গে আলোচনা করল। আমরা কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে পরামর্শ করে একমত হয়ে যাইনি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতামতগুলো তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ লিখিত আকারে তুলে ধরেছেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, একটি কাঠামোর মাধ্যমে নিয়োগ দিন। প্রক্রিয়াগুলো স্বচ্ছ রাখুন। তাহলে মানুষের আস্থা বাড়বে। সিলেকশনের যোগ্যতার মাপকাঠি তারা নিজেরা বসে চিন্তা করুন। আমরা চিন্তার খোরাক তাদের কিছুটা দিয়েছি।’ অন্যদিকে এস এম এ ফায়েজ ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি।

আরও পাঁচ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ : আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় আরও পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে বসবে সার্চ কমিটি। সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে এ বৈঠক হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, সাবেক সিইসি আবু হেনা, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুর রশীদকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে এ সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম প্রস্তাবের দায়িত্ব দেন। তাদের সুপারিশ থেকেই অনধিক পাঁচ সদস্যের ইসি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। কমিটির অন্য সদস?্যরা হলেন হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মহাহিসাবনিরীক্ষক (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীন আখতার। নিয়ম অনুযায়ী, ছয়জনের এ কমিটির তিনজন উপস্থিত থাকলেই বৈঠক করা যায়। সার্চ কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতিতে অন্তত একজন নারীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজনের নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়েছে। যাতে স্পষ্ট হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক এ সংস্থাটিতে একজন নারীকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি।

 

সর্বশেষ খবর