রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইয়াবার নিয়ন্ত্রণে দুই পরিবার

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া শক্তিশালী নেটওয়ার্ক, মিয়ানমারে কারখানা, সহস্রাধিক মাঠকর্মী পৌঁছে দিচ্ছে জেলায় জেলায়

মির্জা মেহেদী তমাল, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে ফিরে

ইয়াবার নিয়ন্ত্রণে দুই পরিবার

পাহাড়, নদী ও সাগরঘেরা নিসর্গ টেকনাফে মাছ চাষ, লবণ চাষ, কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন সেখানকার মানুষ। বাপ-দাদার পেশাই ধরে রাখার চেষ্টা করেন তারা। হালে এ নিয়ম পুরোপুরি পাল্টে গেছে। পাল্টে দিয়েছেন টেকনাফের দুটি পরিবার। ইয়াবা নামক আলাদিনের চেরাগ তারা তুলে দিয়েছেন টেকনাফের সাধারণ মানুষের হাতে হাতে। ছোটখাটো চালান বিক্রিতেই অনেক লাভ! লোভে পড়তে শুরু করে মানুষ। চেরাগ ধরার গতি বেড়ে যায় তাদের। এ-ঘর থেকে ও-ঘর। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। ধুম পড়ে যায় ইয়াবা বিক্রির। অল্প দিনেই একজন লবণচাষি বনে যান কোটিপতি। ঠেলাচালকের হয় কোটি টাকার প্রাসাদ। আর সর্বনাশা এই ইয়াবা টেকনাফ ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আসক্ত হয় ইয়াবায়। আর টেকনাফের সেই দুই পরিবার ইয়াবা বেচে হয় হাজার কোটি টাকার মালিক।

টেকনাফ ঘুরে বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ইয়াবা বিস্তৃতির এই নেপথ্যের তথ্য। আর যে দুটি পরিবার এ কাজটি করেছে এরা এখন ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর নেতা। একটি পরিবারের একজন হলেন কক্সবাজার-৪ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি আবদুর রহমান বদি। অপরজন বদির ডান হাত জাফর আহমদ, যিনি টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান। বদি তার ভাই-বেয়াইদের নিয়ে ইয়াবার ব্যবসা করছেন বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। আর জাফর আহমদ তার ছেলেদের নিয়ে এ ব্যবসায় দীর্ঘদিন ধরেই। টেকনাফ-উখিয়ার মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় এদের প্রত্যেকের নাম রয়েছে শীর্ষস্থানে। মূলত এমপি বদি আর চেয়ারম্যান জাফরের পরিবারই নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশের ইয়াবার সাম্রাজ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইয়াবা আসছে শুধু মিয়ানমার থেকেই। আর মিয়ানমার থেকে  আসছে বলেই টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। সেখানে এমপি বদি আর জাফরের নলেজ ছাড়া এক পিস ইয়াবাও প্রবেশ করানো সম্ভব নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বর্তমানে সারা দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখের ওপরে। আর এর অর্ধেকই ইয়াবায় আসক্ত। অর্থাৎ ২৫ লাখ ইয়াবাসেবী রয়েছে দেশে, যাদের প্রতিদিনকার চাহিদা রয়েছে কম করে হলেও ৫০ লাখ পিস ইয়াবার। সূত্রগুলোর মতে, প্রতিদিন এ সংখ্যার চেয়ে বেশি ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। আর এর পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে এই দুই পরিবার। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজারের দুই শতাধিক বড় মাপের ইয়াবা ব্যবসায়ী। টেকনাফবাসীর অভিযোগ, ইয়াবা ব্যবসা জিইয়ে রেখেছেন প্রশাসনের লোকজন। যে কারণে ব্যবসায়ীর সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। টেকনাফের ৯০ শতাংশ মানুষই এখন এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় এমপি, ক্ষমতাধর রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করায় কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না এর আগ্রাসন। টেকনাফের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা ব্যবসায় সরাসরি জড়িত। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জাফর আহমেদ একসময় ছিলেন পান ব্যবসায়ী। তিনি এখন ইয়াবা বেচে হয়েছেন গডফাদার। তিনি এবং এমপি বদি মিলে এলাকার ঘরে ঘরে সৃষ্টি করেছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী। সূত্র জানায়, ইয়াবার চালানের নেটওয়ার্ক পুরোটাই এমপি বদির। তার দেখভাল করেন জাফর আহমেদ। এরা দুজনই মিয়ানমারে গড়ে তুলেছেন ইয়াবার কারখানা। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তাদের ভয়ংকর নেটওয়ার্ক। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেকনাফে কোনো রাজনীতি নেই। নেই কোনো দলাদলি। মাঝেমধ্যে টেকনাফের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির কর্মকাণ্ড নিয়ে হইচই হয়। এতটুকুই। তারা বলেছেন, টেকনাফে রাজনীতিকরা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত নন। তারা সবাই ব্যস্ত ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে। ইয়াবা ব্যবসাই এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবকিছুর মূলে। ইয়াবা ব্যবসার প্রশ্নে রাজনীতিকদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কেন্দ্র কী বলল না বলল, তাতে টেকনাফের রাজনীতিকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ইয়াবার চালান আসছে কি না ঠিকমতো, এটাই তাদের মূল রাজনীতি। বিজিবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার অন্তত ৪৫টি রুট দিয়ে ইয়াবা আসে। সমপ্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বলা হয় এক হাজার ২০০ জনের বেশি। দুই বছর আগের তালিকায় ছিল ৫৫৪ জন। এতে কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আবদুর রহমান বদি, তার আপন দুই ভাই ও দুই সৎ ভাই রয়েছেন। রয়েছেন তার অনেক ‘অনুসারী’। ওই তালিকায় বদির আপন ভাই মো. আবদুল শুক্কুর ও মৌলভি মুজিবুর রহমান, দুই সৎ ভাই আবদুল আমিন ও ফয়সাল রহমানের নাম এসেছে। এর বাইরে বদির বেয়াই আখতার কামাল ও শাহেদ কামাল, মামা হায়দার আলী, মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল এবং ভাগ্নে নিপুও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বদির ঘনিষ্ঠ ও ডান হাত জাফর আহমেদ এবং তার চার ছেলের নাম রয়েছে শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে। এরা হলেন শাহজাহান, ইলিয়াস, দিদারুল আলম ও মোস্তাক আহমদ। শাহজাহান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বড় ছেলে মোস্তাক আহমেদ রয়েছেন নিখোঁজ। টেকনাফের সাধারণ মানুষ আক্ষেপ করে জানান, সৌন্দর্যের লীলাভূমি টেকনাফ ইয়াবায় এখন ভেসে থাকে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কারণেই সাধারণ মানুষ আর এখানে বসবাস করতে চান না। অনেকে বাইরে পরিচয় পর্যন্ত দেন না। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, টেকনাফের মানুষের প্রধান ব্যবসাই ইয়াবা। টেকনাফের রাজনীতি আর অর্থনীতি—সব চলছে ইয়াবাকে কেন্দ্র করেই। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই, যারা ইয়াবার ব্যবসায় জড়িত নন। ইয়াবা এখন এতটাই লাভজনক ব্যবসা যে লবণ, মাছ চাষ ও কাঠসহ বিভিন্ন বৈধ ব্যবসা ছেড়ে শত শত ব্যবসায়ী ইয়াবায় অর্থ লগ্নি করছেন। আর এসব কারণে সীমান্তবর্তী টেকনাফ হয়ে উঠেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। মাফিয়াদের বিচরণে মুখরিত থাকছে সৌন্দর্যের অপর লীলাভূমি টেকনাফ। অনুসন্ধানে ইয়াবা ব্যবসায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সংশ্লিষ্টতা যেমন পাওয়া গেছে, তেমনি পাওয়া গেছে বিএনপি নেতাদেরও। টেকনাফে সাধারণ মানুষ এখন অসহায়। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ভয়ে তারা কখনো মুখ খোলেন না। যে দু-একজন মুখ খুলেছেন তাদের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফে এমন কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা গড়ে উঠেছে, যা শুধু ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত। সাধারণ মানুষের জন্য নয়। অচেনা লোকজনের জন্য ওই অঞ্চল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া টেকনাফে চাকরি করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই অঞ্চলকে ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ হিসেবেই মনে করেন, যে কারণে তারাও এই পথে টাকা রোজগারে বেপরোয়া হয়ে পড়েন। টেকনাফ এখন ভয়ংকর অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ শহরে দাঁড়িয়ে যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই দেখা যায় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের। দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা মূল্যের মোটরসাইকেলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ কোটি টাকা মূল্যের গাড়িতে চড়ছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন ইয়াবার চালানের। ইয়াবার গডফাদারদের দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে খোশগল্প করতে। কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, বর্তমান এমপি বদি হলেন হাইব্রিড নেতা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এটা দলের জন্যে অসম্মানজনক। শুধু মাদকের বিষয় নয়, তার বিরুদ্ধে সরকারি বহু কিছু আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। অবশ্যই এটা দলের কেন্দ্র  থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, তালিকায় আমার নাম ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসাবে আসে নাই। ইয়াবা ব্যবসায়ীর সহযোগি হিসাবে নাম এসেছিল। তিনি বলেন, প্রথমে একটা তালিকা হয়েছিল। ওটাতে আমার ছেলের নাম শত্রুতা করে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর