মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

টেকনাফে ঘরে ঘরে ইয়াবা ব্যবসা

চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও মেম্বাররা সবাই জড়িত বাণিজ্যে

মির্জা মেহেদী তমাল, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে ফিরে

টেকনাফে ঘরে ঘরে ইয়াবা ব্যবসা

‘মাদক বেচে টাকা গড়ি, ঝুলবে গলায় ফাঁসির দড়ি’— মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এমন পোস্টার সাঁটানো আছে টেকনাফ পৌরসভা, উপজেলা পরিষদসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের দেয়ালে। অথচ পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ যারা চালাচ্ছেন সেই চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর আর মেম্বাররাই ভয়ঙ্কর ইয়াবা ব্যবসায়ী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব আর বিজিবির মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকের তালিকায় এদের নাম রয়েছে প্রথম সারিতেই। মাদক ছাড়াও কারও কারও বিরুদ্ধে থানায় রয়েছে মানব পাচারের মামলা। কোটিপতি বনে যাওয়া এ ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই এখন টেকনাফের জনপ্রতিনিধি। এদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, ইয়াবা মাফিয়ারা নিজেরাই নিজেদের অফিস ভবনের দেয়ালে মাদকবিরোধী পোস্টার লাগিয়েছেন। এ অবস্থায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এ স্লোগানটি এখন টেকনাফে উপহাসে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মেম্বার প্রার্থীরাই নির্বাচনে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন। আর চেয়ারম্যান প্রার্থীরা কী পরিমাণ খরচ করতে পারেন, তা চিন্তার বাইরে। নির্বাচিত হওয়ার পর এ জনপ্রতিনিধিরাই ঘরে ঘরে ইয়াবার ব্যবসা শুরু করেছেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি হয়ে টেকনাফকে ইয়াবা নগরীতে পরিণত করেছেন। আগে কখনো কখনো তাদের গাঢাকা দিতে হতো। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হওয়ায় এখন তা আর প্রয়োজন পড়ে না। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে ইয়াবা ব্যবসাকে তারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। যে কারণে ইয়াবা পাচার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রকাশ্যে এরা ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ এখন আর তাদের ছোঁয় না। এই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই আবার টেকনাফে মাদকবিরোধী সভা-সেমিনারে বক্তব্য দেন। তারা মনে করেন, ইয়াবায় অসম্ভব বলতে কিছুই নেই। আলাদিনের এ আশ্চর্য প্রদীপের কারণে সব পাওয়া যায় হাতের মুঠোয়। রাতারাতি হয়ে যায় বাড়ি, গাড়ি, বেড়ে যায় ব্যাংক ব্যালান্স, হয়ে যায় আলিশান ফ্ল্যাট, গ্রামের টিন থেকে বহুতল ভবন ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, পুরনো পরিচয় মুছে তৈরি করা যায় নতুন পরিচয়ও। তাই হাসপাতালের স্বল্প বেতনের কর্মচারী এখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। কিছু দিন আগেও হাসপাতালের কর্মচারী রাকিব হিসেবে পরিচিত থাকলেও এখন মেম্বার নির্বাচিত হয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান পর্যন্ত হয়েছেন তিনি। এমনটি ঘটেছে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নে। গত ইউপি নির্বাচনে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হয়েছেন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী ‘নুরুল হক ভুট্টো’ সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান রাকিব আহমেদ। আসামি গ্রেফতারের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইয়াবা চোরাচালানের মূল রুট কক্সবাজারের পাচারকারী ও গডফাদারদের নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে তালিকা আছে। তেমনি অন্য সংস্থাগুলোও আলাদাভাবে তালিকা তৈরি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান হয়। ইয়াবা চোরাকারবারিদের মধ্যে কে জনপ্রতিনিধি আর কে জনপ্রতিনিধি নন তা ভাবার বিষয় নয়।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মাদক ব্যবসায়ীদের যে তালিকা রয়েছে সে তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। টেকনাফের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ৮০ ভাগই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এদের কেউ নির্বাচিত হলেও পুলিশের ভয়ে শপথ অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। পরে সব দিক ‘ম্যানেজ’ করে শপথের কাজটি করেছেন। টেকনাফ উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হলেন জাফর আহমেদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব কটি সংস্থার তালিকায় তার নাম রয়েছে প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে। যে দুটি পরিবার ইয়াবার নিয়ন্ত্রণ করে, এর একটি হলো জাফর পরিবার। তার ছেলে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুর বিল অংশের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের নামও রয়েছে তালিকায়। তার অন্য দুই ভাইয়ের নামও রয়েছে ওই তালিকার শুরুতেই। মাদকের তালিকায় আছে আলীর ডেইল এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আকতার কামালের নাম। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে আরও যাদের নাম তালিকায় রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার এনামুল হক, সাবরাং ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান নুর হোসেন, ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আকতার কামাল, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শামসুল আলম, নয়াপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোহাম্মদুর রহমান, সাবরাং ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন দানু, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন, হ্নীলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জামাল হোছাইন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নুরুল হুদা, ৯ নম্বর ওয়াডের মোহাম্মদ আলী। এ ছাড়া টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমানের নাম ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় সাত প্রভাবশালীর একজন হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। একই তালিকায় ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হক, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুর বশর নুরসাদ ইয়াবা মাফিয়া। কক্সবাজারের সচেতন মহল মনে করে, ইয়াবার থেকে আয় করা বিপুল অঙ্কের টাকা নির্বাচনে বিনিয়োগের কারণে এরা জনপ্রতিনিধি হন। এ কারণে এসব ইয়াবা সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়েছে।

সর্বশেষ খবর