শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নতুন ট্রানজিটে লণ্ডভণ্ড ভৈরব

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, ভৈরব থেকে ফিরে

বাণিজ্যনগরী খ্যাত কিশোরগঞ্জের ভৈরবে অন্য সব ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাদকেরও রমরমা বাণিজ্য চলছে। এখানে অনেকটা ফ্রিস্টাইলে চলে মাদকের ব্যবসা। একসময় শুধু ফেনসিডিলের রাজত্ব থাকলেও এখন ইয়াবার রামরাজত্ব শুরু হয়েছে। ভৈরব শহরের  অলিগলিতে বিভিন্ন কৌশলে চলছে মরণ নেশা ইয়াবার ব্যবসা। আর এ ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি অনেকেই। সড়ক, রেল ও নৌপথের কেন্দ্রস্থল ভৈরব। এ তিন পথের সুবিধায় এখন ইয়াবার ট্রানজিট হিসেবেও ভৈরবকে ব্যবহার করছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এখানে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবাসহ নানা মাদক। টেকনাফের নাফ নদের ওপার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি ট্রেন, বাস, নৌকাযোগে ভৈরবে এসে অনেকটা বিনা বাধায় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ভৈরবকে অঘোষিতভাবে নতুন ট্রানজিট রুট বানিয়েছেন। ট্রেনে আসা ইয়াবার চালান স্টেশনের পাশেই পুকুরপাড়ের বউবাজারের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে স্টক করা হয়। আর যাত্রীবাহী বাসে আসা ইয়াবার চালানের ঢাকা রোডের নারায়ণপুরে লাল মিয়া ফিলিং স্টেশনের রেস্টুরেন্টে বসে লেনদেন হয় বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, মেঘনা নদীর ওপার আশুগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকেও ইয়াবা পাঠানো হয় সিলেটের বিভিন্ন জেলায়।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা থেকে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম রেলপথের কেন্দ্রস্থল ভৈরব। রেলস্টেশনেই ছদ্মবেশী ২০-২৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর আনাগোনা দেখা যায়। কৌশলী ব্যবসায়ীরা স্টেশনে ট্রেন আসামাত্রই ইশারা-ইঙ্গিতে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক নিয়ে নিরাপদে চলে যান। অন্যদিকে ভৈরব দুর্জয় মোড় বাসস্ট্যান্ডে নাইট কোচের মাধ্যমে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবার চালান এসে ভাগবাটোয়ারা হয়ে বিভিন্ন পথে চলে যায়। ভৈরব শহরের পঞ্চবট্টি পুকুরপাড়, আমলাপাড়া, নিউটাউন, জগন্নাথপুর রেলক্রসিং, কমলপুর গাছতলা ঘাট, চণ্ডীবেড়, হাসপাতাল রোড, কালীপুর, কালিকাপ্রসাদ এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের ঘাঁটি বলে জানা যায়।

ভৈরব পৌর এলাকায় একজন করে সিন্ডিকেট-প্রধান হয়ে আটটি স্থানে বানিয়েছেন ইয়াবার পাইকারি আড়ত। ওই সিন্ডিকেট-প্রধানদের অধীন রয়েছেন কয়েকজন করে বেতনভুক মাঠকর্মী। মাঠকর্মীদের মাসিক বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। কেউ কেউ আবার দৈনিক বিক্রির ওপর ভিত্তি করেও বেতন নেন। প্রতি পিস ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করে তারা পান ২৫ টাকা। ভৈরব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, আমলাপাড়া গ্রামের মনা, ফাতেমা বেগম, লাকী বেগম, হোসেন মিয়া; ঘোড়াকান্দা গ্রামের মানিক, বাবুল; গাছতলাঘাট এলাকার শফিক, দুলাল, জামাল; পঞ্চবট্টি পুকুরপাড় এলাকার জাকির, মাইগ্গা আলম, তোফাজ্জল, হেলিম, রহিমা বেগম, সুমি বেগম, লাইলী বেগম, রত্না বেগম, রাজন মিয়া, পারভীন বেগম, শিল্পী বেগম; নিউটাউনের অপু; জগন্নাথপুরের জিল্লু ও শেখ ফরিদ ওইসব ইয়াবা আড়ত নিয়ন্ত্রণ করছেন। এসব ইয়াবা ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে আবারও একই ব্যবসায় নেমে পড়েন। কারণ, এ ব্যবসা করে এদের বেশির ভাগই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। এর মধ্যে অতি অল্প সময়ে চণ্ডীবেড় গ্রামের মনা মিয়ার ছেলে ফরিদ দিনমজুর থেকে এখন কোটিপতি। তার রয়েছে পাঁচটি বহুতল বাড়ি। তার বিরুদ্ধে ভৈরব, নরসিংদী, আশুগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মাদক পাচারের বহু মামলা। ইয়াবা পাচারে তার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। একাধিক মাইক্রোবাস নিয়ে পাহারা দিয়ে তার মাদকের চালান বিনা বাধায় পাঠান রাজধানী ঢাকায়। ইয়াবা ব্যবসায়ী ফরিদ এতটাই চৌকস যে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার দূরের কথা, রীতিমতো পুলিশই ফরিদ ও তার সহযোগীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। শুধু ফরিদ নন, কাইয়ুম, তোফাজ্জল, জিল্লু মিয়াসহ ৮-১০ জন ইয়াবার ব্যবসা করে এখন কোটিপতি। ভৈরবে মাদক বাণিজ্যের আলাদা বাহিনী রয়েছে নারী ও শিশুদের নিয়ে। নারী সদস্যরা তাদের সুবিধার্থে শিশু বাচ্চা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করেন। আর এসব বাচ্চা নিয়ে কাজে যাওয়ার আগে শিশুকে পেট ভরে খাবার দেন না তারা। ধরা পড়লে শিশুটিকে ঘন ঘন চিমটি দিতে থাকেন। এতে শিশুটি উচ্চ স্বরে কাঁদতে শুরু করে। সে সময় এক ধরনের সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করে পুলিশকে বোকা বানিয়ে চলে যান নিরাপদে। মাঝেমধ্যে ধরা পড়লে শিশুটিকে দেখিয়ে বলেন, ‘শিশুর দুধ কেনার টাকা নেই। এজন্য এসব কাজ করি।’ প্রশাসন ও বিচারকদের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করতে নারী মাদক বহনকারীরা শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে ব্যবহার করছেন বলে জানায় পুলিশ। মাদক ব্যবসায়ীরা ভৈরব থেকে টঙ্গী ও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন। ভৈরব মূল থানাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠানে নারী সদস্য নেই। এ সুযোগটি নেন নারী ইয়াবা ব্যবসায়ী বা বহনকারীরা। তারা শরীরে মাদকদ্রব্য পেঁচিয়ে বহন করেন। অভিযোগ রয়েছে, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে থাকেন। ভৈরব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজমুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলপথ, সড়কপথ ও নৌপথের সুবিধার জন্য ভৈরব মাদক ব্যবসার ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এখান থেকে চোরাপথে ওইসব মাদক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হচ্ছে। ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোখলেছুর রহমান জানান, গত এক বছরে ভৈরব থানায় ৫০০-এর বেশি মামলা হয়েছে মাদকের। আর এসব মামলায় হাজারের বেশি মাদক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর