শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
আ- মরি বাংলা ভাষা

বাংলাদেশের সাহিত্য ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু

রফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের সাহিত্য ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক উৎসব হলো কার্জন হলের সামনের মাঠে। পূর্ব বাংলার নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পানির পাইপ দিয়ে তৈরি ‘ফ্ল্যাগমাস্ট’-এ একটি চাঁদতারাখচিত সবুজ মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করলেন। ‘শিখ’ রেজিমেন্টের একটি দল (তখনো ভারতে যায়নি) একজন ব্রিটিশ অফিসারের কমান্ডে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করল। কবি জসীমউদ্দীনের নেতৃত্বে কলকাতা থেকে আগত বাংলাদেশ সরকারের ‘পাবলিসিটি’ ডিপার্টমেন্টের আব্বাসউদ্দীন আহমদের পরিচালনায় সোহরাব হোসেন, বেদারউদ্দিন আহমদ, হাসান আলী খান, শমসের আলী প্রমুখ শিল্পী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলেন কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘পাকিস্তানের অভাব কী’? আর কবি জসীমউদ্দীনের ‘আমার সোনার পাকিস্তান, আমার পূর্ব পাকিস্তান’। ব্যস, পাকিস্তান হয়ে গেল। আমি ওই অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তুলেছিলাম কিন্তু সেগুলো ভালো হয়নি। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ আর তার বোন ফাতেমা জিন্নাহ্ ঢাকায় এসে রমনায় ঘোড়দৌড় মাঠে জনসভায় যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, আমি আমার বক্স ক্যামেরায় তার ছবি তুলেছিলাম কিন্তু সে ছবিও ভালো হয়নি।

ভাগ্যক্রমে ১৯৪৯ সালের দিকে আমার এক বিলাতফেরত ভাইয়ের কাছ থেকে একটি ভালো জার্মান ক্যামেরা উপহার পাই। ক্যামেরাটি ছিল ‘ভয়েগ ল্যান্ডার’ ‘ফোর পয়েন্ট ফাইভ ল্যান্সরিফ্লেক্ট ক্যামেরা’। এই ক্যামেরা দিয়ে আমি যথার্থ ফটোগ্রাফি শুরু করি। ১৯৫০ সালে ঢাকা ‘আর্ট গ্রুপ’-এর উদ্যোগে ঢাকা হলসংলগ্ন ‘লিটন হল’-এ ঢাকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে যেসব চিত্রকলা স্থান পেয়েছিল তার প্রায় সব ছবিই আমাকে তুলতে হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল জয়নুল আবেদিন, শফিউদ্দিন আহমদ, কামরুল হাসান, শফিকুল আমিন, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, হামিদুর রহমান, আবদুর রউফ, সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্রমুখ শিল্পীর শিল্পকর্ম। ১৯৫২ থেকে ’৫৭ সালের মধ্যে আমি এই নতুন ভয়েগ ল্যান্ডার ক্যামেরা দিয়ে অনেক ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় ছবি তুলেছি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বাংলা ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৩ সালের প্রথম শহীদ দিবস উদযাপন, ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক সাহিত্য সম্মেলন, ১৯৫৫ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ঢাকা সফর এবং বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। এ ছাড়া পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃতি সংসদ’, ‘ডাকসু’ এবং ‘ড্রামা সার্কেল’ মুনীর চৌধুরী ও নুরুল মোমেনের পরিচালনায় যেসব নাটক মঞ্চস্থ করেছিল, তার প্রায় সবগুলোরই ছবি তুলেছিলাম। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় পুনরায় ঘোষণা দিলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সমাজসচেতন ও আন্তর্জাতিক চেতনাসম্পন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের প্রথম সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র সমাজ ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম ‘প্রতিবাদ দিবস’ এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ‘পতাকা দিবসে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। আমি ওইসব প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার ছবি তুলেছিলাম। বাংলাদেশের সাহিত্য ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু। হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উপলক্ষে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি সংকলন করেছিলেন। সেখানে আলাউদ্দীন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মুর্তজা বশীর, ফজলে লোহানীসহ অনেকের লেখা ছাপা হলো। তার আগ পর্যন্ত এখানে যেসব লেখা হতো তা কলকাতাকেন্দ্রিক লেখার অনুকরণ বা অনুসরণ। একুশের সংকলনের মধ্য দিয়ে আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতির আন্দোলন গড়ে উঠল। তবে অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনো নিশ্চিত হলো না। লেখক : ভাষাসংগ্রামী ও ইমেরিটাস অধ্যাপক

সর্বশেষ খবর