রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ ঘাটের দুই এয়ারপোর্ট

মির্জা মেহেদী তমাল, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে ফিরে

বিশ ঘাটের দুই এয়ারপোর্ট

সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ, হারিয়ে যাওয়ার বিপদ, মৃত্যুভয়— কোনো কিছুই যেন বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না হতদরিদ্র মানুষের। মৃত্যুকে কবুল করেই তারা ট্রলারে চেপে বসছে। পৌঁছে যেতে চায় স্বপ্নের ঠিকানা মালয়েশিয়ায়। এসব পথেই টেকনাফ-উখিয়ার কয়েক শ তরুণ, যুবক দেশ ছেড়েছিলেন তিন বছর আগে। ফেরেননি তারা। কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন জানে না কেউ। আদৌ বেঁচে আছেন কিনা এ নিয়ে শঙ্কায় পরিবারের সদস্যরা। তারা এখনো প্রহর গুনছেন, ঘরে ফিরবে সন্তান, যাকে ট্রলারে তুলে দিয়েছিলেন তারই বাবা, ভাই কিংবা স্বজনরা।

টেকনাফ ও উখিয়ায় সরেজমিনে জানা গেছে, শত যুবকের নিখোঁজের শোক এখনো কাটেনি। টেকনাফ আর উখিয়ার কান্না এখন এই নিখোঁজ যুবকেরা। ঘরে ঘরে সেই কান্না থামেনি। তবে কান্না না থামলেও সেই পাচারকারী চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকা এই পাচারকারীরা আবারও প্রকাশ্যে। লোকজন জোগাড় করে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ট্রলারে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাগরপথের আলোচিত দুই ‘এয়ারপোর্ট’ আবারও সচল হয়ে উঠেছে। সাগর-সংলগ্ন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ আর উখিয়ার সোনাইছড়ির ২০টি ঘাট দিয়ে মানব পাচার শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় বলেই এ দুটি এলাকাকে এয়ারপোর্ট বলে থাকেন স্থানীয়রা। মানব পাচারকারীরা তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। আগে ট্রলার ভর্তি করে পাচার করলেও এখন এত বেশি লোক ওঠানো হচ্ছে না। মাঝির ছদ্মবেশে তাদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারে মানব পাচার নিয়ে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘হেল্প কক্সবাজার’। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবৈধ পথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যেতে নগদ টাকা দিতে হয় না’— দালালদের এমন প্রলোভনের ফাঁদে প্রায় প্রতিদিনই পা দিচ্ছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। প্রথম অবস্থায় বিনা খরচে তারা পৌঁছে যান থাইল্যান্ড সীমান্তে। ট্রলারে চড়ে সাগরপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছার পর তাদের ঠিকানা হয় পাচারকারীদের বন্দীশালা। থাইল্যান্ড উপকূলের পাহাড়-জঙ্গলে একাধিক বন্দীশালা তৈরি করে রেখেছে সেখানকার পাচারকারীরা। এরপর তাদের ওপর শুরু হয় অর্থ আদায়ে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। পাচারকারীরা সেখান থেকে মোবাইল ফোনে বাংলাদেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই সময় ফোনে নির্যাতিতদের আর্তচিৎকারও শোনানো হয়। পাশাপাশি মালয়েশিয়া পৌঁছানো বাবদ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা টেকনাফ-কক্সবাজারে অবস্থানরত দালালদের হাতে পৌঁছানোর অনুরোধ জানানো হয়। তখন পরিবারের সদস্যরা নিরুপায় হয়ে, যেভাবে পারেন দালালদের হাতে তুলে দেন নির্ধারিত টাকা। এরপর তাদের থাইল্যান্ড সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে হাঁটাপথে পৌঁছানো হয় মালয়েশিয়ায়। সেখানে তাদের গ্রহণ করে দালাল সিন্ডিকেটের অন্য একটি গ্রুপ। অবৈধ পথে প্রবেশ করায় থাইল্যান্ড-মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন কয়েক হাজার মালয়েশিয়াগামী নিরীহ মানুষ। মালয়েশিয়ার গহিন জঙ্গলে অনাহারে-অর্ধাহারে মারা গেছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি। পাশাপাশি স্বপ্নের মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে গত প্রায় পাঁচ বছরে সাগরে সলিলসমাধি বা নিখোঁজ হয়েছেন সহস্রাধিক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৫ সালের দিকে ফয়েজ উল্লাহ মাঝি ও ধলু হোসেনের নেতৃত্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে ফিশিং বোটে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার শুরু হয়। এরপর রশিদ উল্লাহ মাঝি, পোয়া মাঝি, নবী হোসেন মাঝি, আইয়ুব আলী মাঝি, এজাহার মাঝির নেতৃত্বে ধীরে ধীরে মালয়েশিয়ায় পাচার সম্প্রসারিত হতে থাকে। এরাই মূলত বঙ্গোপসাগরে সাত-আট দিন ফিশিং ট্রলার চালিয়ে শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে থাইল্যান্ড উপকূলে অবৈধ অভিবাসীদের নামিয়ে দিয়ে আসত। সেখান থেকে পাচারকারী সিন্ডিকেটের অন্য দল তাদের গ্রহণ করত।

সূত্র জানায়, মানব পাচারে যারা জড়িত তারা প্রত্যেকেই প্রভাবশালী। মানব পাচার করে এরা শতকোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। গোয়েন্দা সংস্থা মানব পাচারে জড়িত ৪৬১ জনের তালিকা তৈরি করে। এদের মধ্যে ৩৫৯ জনই টেকনাফের বাসিন্দা। এর মধ্যে উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই মজিবুর রহমান ও ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপুসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও তাদের স্বজনদের নাম রয়েছে। তালিকায় ৪২ জন মিয়ানমারের ও পাঁচজন মালয়েশিয়ার। ১০০ জন বিভিন্ন মানব পাচার মামলার আসামি। রয়েছে ১৪ জন নারীও।

পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কড়া নজরদারি না থাকায় উপজেলার জালিয়া পালং ইউনিয়নের দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার সমুদ্র চ্যানেল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এ সমুদ্রসৈকতটি সরাসরি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় মালয়েশিয়া মানব পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। বিশেষ করে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় শরণার্থী ক্যাম্প থাকায় ক্যাম্পভিত্তিক একাধিক দালাল চক্র মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। থানা পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে কিছু দালাল আটক করতে সক্ষম হলেও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় থাকায় মানব পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।

 

সর্বশেষ খবর