রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
আ-মরি বাংলা ভাষা

সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে আরেকটি বায়ান্ন চাই

মোহন রায়হান

সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে আরেকটি বায়ান্ন চাই

‘মা’ শব্দটি উচ্চারণমাত্রই এক অপূর্ব শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে স্নায়ুর সর্বত্র! ঠিক তেমনি বাংলা ভাষা শব্দটিও আমাদের ভিতরে এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি করে! অথচ মাতৃসমা মাতৃভাষাকে বিজাতীয় বিভাষীয় অপসংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন কিছু মানুষ বিকৃত, লাঞ্ছিত, অপমানিত করে নির্বাসনে পাঠাতে চায়!

মনে পড়ে স্কুলজীবনে বইখাতা হাতে নিয়েই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করার দিনগুলোর কথা। দোকানপাট, অফিস-আদালত, প্রতিষ্ঠানসমূহের সাইনবোর্ডের ইংরেজি লেখা আলকাতরা দিয়ে ঢেকে দেওয়া কিংবা ভেঙে ফেলার কথা। বড় আশা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমের সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে, চালু হবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা। শিক্ষার্থী পাবে মাতৃভাষার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পলিতে স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয় ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তা মহিরুহে পরিণতির মাধ্যমে অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সেই স্বপ্নও বাস্তবায়িত হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। হ্যাঁ, রক্তে লেখা সংবিধানেও লেখা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু বাংলা আজ কোথায়? সংবিধানের ধারা, আইন বাস্তবায়ন করবে যে আদালত তার ভাষা কী? রাষ্ট্র পরিচালনা করবে যে মন্ত্রণালয় তার ভাষা কী? জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার পীঠস্থান স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কোন ভাষার প্রাধান্য আজ? একবাক্যে স্বীকার করতে হবে ইংরেজি ভাষার দাপটের কথা!

আমরা কোনো ভাষা শিক্ষারই বিরোধী নই তবে সর্বাগ্রে মাতৃভাষা। মাতৃভাষা ছাড়া কোনো শিক্ষাই পূর্ণাঙ্গ কিংবা সুসম্পন্ন হয় না। কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমে যে কোনো বিষয় যতটা উপলব্ধি বা হৃদয়ঙ্গম সম্ভব অন্য কোনো ভাষার মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। সে কারণেই মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, বিশেষজ্ঞ ড. আহমদ শরীফ, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রফেসর আবুল কাসেম ফজলুল হক, আহমদ ছফা, ড. হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ এ বিষয়টি বার বার তাদের লেখায়, বক্তৃতায়, আলোচনায় তুলে ধরেছেন; শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবি করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর এত বছর অতিবাহিত হলেও কেন তা সম্ভব হলো না? বরং এখন সর্বত্র ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা আর সর্বস্তরে ইংরেজি ভাষা চালুর এক জোরদার প্রচেষ্টা আর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের এক সুগভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তারই অংশ হিসেবে এফএম রেডিওতে, টেলিভিশন নাটকে বিকৃত বাংলা উচ্চারণে চলছে বিদেশি অপ-সিরিয়ালের রমরমা প্রদর্শন! সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে যেটুকু বাংলার ব্যবহার তাও ভুল বানান আর ভুল বাক্যের অনন্য দলিল।

ঘুরেফিরে বাংলাদেশে যে দুটি দল ক্ষমতায় আসে তাদের একটি মুক্তিযুদ্ধের সিলমোহরকৃত আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষক। প্রথমটি কাগজে-কলমে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। আর দ্বিতীয়টি তো ১৯৭৮ সালে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য ঘোষণা করেই বাংলা ভাষার আজকের এই পরিণতির পথ সুগম করেছে।

কিন্তু এ অবস্থা কি চলতে দেওয়া যায়? না, আমরা তা হতে দিতে পারি না। একজন প্রকৃত বাঙালি বেঁচে থাকতেও তা হতে দেওয়া উচিত নয়। তাহলে কী আমাদের করা উচিত?

হ্যাঁ। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই পারে তা বাস্তবায়ন করতে, যদি জনগণ তা চায়। আর জনগণই একমাত্র শক্তি রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে তার দাবি প্রতিষ্ঠার। ১৯৫২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০-এ এ দেশের জনগণ তা প্রমাণ করতে পেরেছে। হ্যাঁ, আবারও আমাদের রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সর্বস্তরে চালু করতে। প্রয়োজনে বুকের রক্ত ঢেলে আরেকটি বায়ান্নর জন্ম দিয়ে হলেও। লেখক : কবি 

সর্বশেষ খবর