বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাদক ব্যবসায়ী ও পুলিশের যৌথ রিসোর্ট সাগরপাড়ে

মির্জা মেহেদী তমাল, কক্সবাজার থেকে ফিরে

মাদক ব্যবসায়ী ও পুলিশের যৌথ রিসোর্ট সাগরপাড়ে

কক্সবাজার সাগর পাড়ের কলাতলী পয়েন্ট। হোটেল-মোটেল জোনে ওশান প্যারাডাইস আবাসিক হোটেলের পাশেই নির্মাণাধীন একটি রিসোর্ট। অত্যাধুনিক দোতলা এই রিসোর্টটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর এই রিসোর্টটির মালিক জসিম উদ্দিন এবং সাইফুল করিম। প্রথমজন হচ্ছেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা। অপরজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। ইয়াবা সম্রাট বলেও তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। জয়েন্ট ভেঞ্চারে তারা এই রিসোর্টটি নির্মাণ করছেন।

একজন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তার জয়েন্ট ভেঞ্চারে রিসোর্ট তৈরির বিষয়টি নজিরবিহীন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করেই রিসোর্টের কাজ এগিয়ে চলে। যে কারণে এই ভবনের নেপথ্যে যারা রয়েছেন তাদের নাম-পরিচয় গোপন থাকে। ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা এবং নির্মাণাধীন ভবনের আশপাশের স্বল্পসংখ্যক লোকজন বাদে বিষয়টি ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় যিনি পলাতক সেই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে অনেকেই দেখেছেন সেখানে। তারা এসে নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করতেন। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে যাওয়ার পরও তিনি আসতেন রিসোর্টে। কাজ দেখিয়ে দিতেন।

পর্যটননগরী কক্সবাজারে সরেজমিন পুলিশ-ইয়াবা ব্যবসায়ীর যৌথ কারবারের এমন আশঙ্কাজনক তথ্য পাওয়া গেছে। ওই ভবনের নির্মাণ কাজ করেছেন নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কথা বলতে রাজি হন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্পর্কের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। তারা জানান, পুলিশের ওই কর্মকর্তা কক্সবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থাকার সময় থেকেই সখ্যতা গড়ে ওঠে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল করিমের। ঘনিষ্ঠতা তাদের এমনি এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রিসোর্ট তৈরির মধ্য দিয়ে যৌথ ব্যবসায় নেমেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিসোর্ট নির্মাণের অনুমতি নেওয়ার ধার-ধারেননি তারা। নিজেরাই নিজেদের মতো করে রিসোর্ট নির্মাণ করেছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই রিসোর্টে জড়িত বলে ঘাঁটাননি কেউ। কক্সবাজার থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওটা আমার কিছু নয়। মুখে বললেই তো হবে না, যারা বলে তাদের কাগজপত্র দেখাতে বলেন। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার থানার ওসি থাকার সময় সেখানে আমি যেতাম, এটা সত্যি। সেখানে জমি নিয়ে ঝামেলা ছিল, তাই যেতে হতো মিটমাট করতে। ডিভাইন নামে এক কোম্পানির সঙ্গে ঝামেলা ছিল অন্য পার্টির। সেটা মিটিয়ে দিয়েছি। কক্সবাজারে সাক্ষীর জন্য যেতে হলে, সেখানেও একবার করে যাই। তবে রিসোর্টটি আমার নয়। সাইফুল করিমের বিষয়ে পুলিশের এই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, আমার শত্রুপক্ষ এগুলো বলতে পারে।

এদিকে অনুমতি না নিয়ে ভবন তৈরির বিষয়টি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদফতরের নজরে আসে গত ডিসেম্বরে। তত দিনে ভবনের দোতলার ছাদ পর্যন্ত হয়ে গেছে। ঘটনাটি ফাঁস হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি দফতরগুলোতে। জানা গেছে, টেকনাফের সাইফুল করিম দীর্ঘদিন ধরেই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। টেকনাফ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন। কক্সবাজারে অবস্থান করেন ব্যবসার কাজে। বর্তমানে তিনি থাকেন চট্টগ্রামে। পুলিশের ওই কর্মকর্তার পোস্টিং এখন চট্টগ্রামে। কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানায়, কোনো কিছুর অনুমতি নেওয়া হয়নি পরিবেশ অধিদফতর থেকে। শুধু তাই নয়, ভবন নির্মাণে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও অনুমতি নেওয়া হয়নি।

পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারা জানতে পেরেছেন সাগর পাড়ের কলাতলী পয়েন্টের হোটেল-মোটেল জোনে নতুন একটি রিসোর্ট করা হচ্ছে অবৈধভাবে। আর ওই নির্মাণাধীন রিসোর্টটির মালিক হচ্ছেন টেকনাফের বাসিন্দা তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি সাইফুল করিম ও চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন। কিন্তু তাদের মালিকানা সম্পর্কিত কোনো কাগজপত্র আমরা পাইনি। যেহেতু ভবন নির্মাণে কোনো অনুমতি তারা নেননি, সে কারণে ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। তাদের পক্ষ থেকে মালিক সংক্রান্ত কাগজপত্র এখনো দেয়নি। গত মাসের শেষে সাগর পাড়ের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের পেছনে ঘুরে দেখা যায় দোতলা বেশ লম্বা দেখতে ভবনটির বাউন্ডারির ভিতর বেশ কয়েকজন শ্রমিক বসে গল্প করছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কোনো কথা বলেননি। তবে সেই সময় তাদের কাজ করতে দেখা যায়নি। ভবনটির পাশেই আরও একটি রিসোর্ট দেখা যায়। সেটির নাম ডিভাইন ইকো রিসোর্ট। রিসোর্টের বাইরেই কথা হয় ওসমান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি ওই ভবনের কেয়ারটেকার ছিলেন একসময়। তিনি বলেন, হোটেলটির মালিক পুলিশের কর্মকর্তা জসিম এবং টেকনাফের সাইফুল করিম। তারা দুজনই মাঝেমধ্যে এসে কাজ দেখাশোনা করতেন। আশপাশের বেশ কয়েকজন জানান, হোটেলটিতে কক্সবাজার সদর মডেল থানার সাবেক ওসি জসিম উদ্দিন এবং দেশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি টেকনাফের সাইফুল করিমকে মাঝেমধ্যে আসতে দেখা যায়। তাদের সেখানে শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে দিতেও দেখা গেছে। স্থানীয়রা আরও জানান, টেকনাফের সাইফুল করিমের পক্ষে কক্সবাজার শহরের নূরপাড়ার বাসিন্দা নিরিবিলি অর্কিডের ম্যানেজার রাশেদ আবেদিন সবুজ হোটেলটির নির্মাণ কাজ দেখাশোনা করেন। যোগাযোগ করা হয় সেই রাশেদ আবেদিন সবুজের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমি নির্মাণ কাজ দেখভালের দায়িত্ব নিই। ভবনটির ডেকোরেশনসহ বিভিন্ন কাজ করিয়েছি ঠিকাদার হিসেবে। রিসোর্টের কাজ প্রায় শেষ দিকে ছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর থেকে কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় সেখান থেকে চলে আসি।’ তিনি বলেন, ‘টেকনাফের সাইফুল করিম শ্বশুর বাড়ির পক্ষের আত্মীয় হন। তার অনুরোধে ওই ভবনের কাজ দেখভালের সঙ্গে যুক্ত হই। শ্রমিকদের পেমেন্ট করি। সারা দিন থাকি’। তিনি বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তার যুক্ত থাকার বিষয়টি সাইফুল করিমের কাছে শুনেছি। ওই পুলিশ কর্মকর্তা এই রিসোর্টের সঙ্গে রয়েছেন বলে জানি তখনই। হোটেলটি নির্মাণের বৈধ কোনো কাগজপত্র আছে কিনা তা জানেন না বলে জানান সবুজ। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, সবুজ চলে যাওয়ার পর ডিভাইন নামের একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাওন সেখানে দেখাশোনা করতে থাকেন। তিনি নানা কৌশলে কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি সবাইকে বলতেন যে, পরিবেশ অধিদফতর থেকে তার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু খবর পেয়ে পরিবেশ অধিদফতর থেকে আবারও কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সূত্রগুলো জানায়, শাওন রাতের আঁধারে নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রিসোর্টের ভিতরের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে বলে জানা যায়।

সর্বশেষ খবর