বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাকিস্তান এখন বই লিখে অপকর্ম ঢাকতে চাইছে : প্রধানমন্ত্রী

শেখ হাসিনা জার্মানি যাচ্ছেন আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তান এখন এই বই লিখে তাদের কৃতকর্ম, গণহত্যা, মানুষকে গুলি করে মারার ঘটনাগুলোকে উল্টো মুক্তিবাহিনীর ওপর দোষ দিয়ে, নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে। এত বড় দুঃসাহস তাদের কোথা থেকে এলো? এটা পাকিস্তানের জন্য লজ্জার বিষয়। তারা এই লেখার সাহস কোথায় পেল? বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মনে হয়, ওই প্রশ্ন তুলেই বিদেশি প্রভুদের সুযোগ করে দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

জাতীয় সংসদের চতুর্দশ ও শীতকালীন অধিবেশনে গতকাল পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সংসদ নেতা এসব কথা বলেন। তার আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের গণহত্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা ছিল। সেখানে ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোজার’ নামক পাকিস্তানের জুনায়েদ আহমেদের লেখা বইটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও ৩০ লাখ শহীদসহ সবকিছুর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা করা হয়েছে। যেহেতু ২৫ মার্চ নিয়ে বিরুপ প্রচার-প্রপাগান্ডা হচ্ছে। সেজন্য ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আমাদের চিহ্নিত করা উচিত। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে যে ম্যাসাকার হয়েছিল তাই ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে আমরা আসুন প্রতি বছর পালন করি। এ ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ জানাবার জন্য তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান।

পরে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ বিষয়ে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে তারা যে গণহত্যা চালিয়েছিল সেখানে কাউকে বাদ দেয়নি। আজকে তারা এই গণহত্যাকে এখন মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপাতে চাইছে। এটা কোনোদিনই গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য সংসদে যথাযথ প্রস্তাবনা আনতে পারি এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাব যাতে করে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়ে যে অপরাধ করেছে, তার জন্য তাদের আমরা বারবার বলেছি, তোমরা মাফ চাও। তারা মাফ তো চাইলোই না, উল্টো এখন তাদের অপকর্মের দায়ভার আমাদের মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা কখনো মেনে নেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা পাকিস্তানের জন্য লজ্জার বিষয়। অথচ তারা এখন বিকৃত তথ্যভরা বই লিখেছে। এর সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা আইএসআই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাদের কত বড় দুঃসাহস; তারা এই বই লিখে সেটা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করাচির হাইকমিশনে পাঠায়। এ জন্য আমরা এই সংসদ থেকে নিন্দা জ্ঞাপন করি।

এরপর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ছাড়াও ইতিমধ্যে একজন সংসদ সদস্য লিখিতভাবে এ বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। এ প্রস্তাবের বিষয়ে মার্চ মাসের যে কোনো একদিন সংসদে আলোচনা করা হবে।

বাংলাদেশ আজকে স্বাধীন। তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ বোধহয় স্বাধীন হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিছুই করতে পারবে না। সেই ষড়যন্ত্রও তারা কিন্তু করেছে। সেই ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটিয়েছে। এরপর ভেবেছিল বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় নাই। বাংলাদেশ আজকে সফল। সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। এটাই বোধহয় পাকিস্তানি জান্তাদের গাত্রদাহ ও জ্বালা। এটাই তারা সহ্য করতে পারছে না। তাই, আজ তারা মিথ্যাচার করছে।

‘ই-ভোটিং’ বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচনে জনমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত কল্পে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জনমানুষের ভোটাধিকার অধিকতর সুনিশ্চিত করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ই-ভোটিং’-এর প্রবর্তন করার পরিকল্পনাও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আমরা চাই পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা হোক। সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে এখন থেকেই সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।?

গতকালের অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে বেগম নূর-ই হাসনা লিলি চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারীকে কমিশনার নিয়োগ দেওয়ায় আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। আমাদের পবিত্র সংবিধানের প্রতি অনুগত থেকে নতুন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দেশবাসীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করি। সরকার নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের আলোকে যে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়ায় এখন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হচ্ছে, সে অবস্থাটি একদিনে তৈরি হয়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল এবং মহাজোটের অন্যান্য শরিক দল নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি অভিন্ন রূপরেখা প্রণয়ন করে। সেখানে ৩০ দফা সুপারিশ করা হয়। অবশেষে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ১৪ দলের দাবি সক্রিয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ সময় ৩০ দফা দাবিকে আরও পরিশীলিত করে ২৩ দফা করা হয়। তার ওপর ভিত্তি করেই ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রবর্তনসহ বিভিন্ন সংস্কার করা হয়। ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার বাদ দেওয়া হয়। এ সময় তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত ৩২টি অধ্যাদেশ/আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতা প্রদানের বিষয় নিয়ে প্রায়শই আর একটি বিতর্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালানো হয়। অথচ এক্ষেত্রে আইনের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যারা ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে প্রস্তাব করেন, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা নয়, প্রকারান্তরে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করাই তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। এ সময় তিনি ২০০১ সালে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের এলাকা থেকে বিতাড়ন/অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতন করে জনমনে ভীতির সঞ্চার করার বিবরণ তুলে ধরেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের অবিচল আস্থা ও অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো অপশক্তিই বাংলাদেশের এ গণতান্ত্রিক ধারার উন্নয়ন অভিযাত্রার পথকে রুদ্ধ করতে পারবে না। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আমাদের পবিত্র সংবিধান, গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছি, ভবিষ্যতেও রাখব ইনশাল্লাহ।

প্রধানমন্ত্রী জার্মানি যাচ্ছেন আজ : চার দিনের এক সরকারি সফরে আজ জার্মানি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ রাত পৌনে ১০টায় হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে তিনি জার্মানির উদ্দেশে রওনা হবেন। জার্মানির মিউনিখে নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন। জার্মানি সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও তিনি কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্র্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।

গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা ইতিমধ্যে ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি এবং অবশ্যই জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে বৈঠকেও এ ইস্যুতে কথা হবে।

মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের জন্য জাতিসংঘ মিয়ানমারকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা সঠিক অবস্থানে রয়েছি। কারণ, সারা বিশ্ব বুঝতে পেরেছে যে রোহিঙ্গারা কতটা দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজার দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র, এটাকে ধ্বংস হতে দেওয়া যেতে পারে না। পরিবেশ ও স্থানীয় লোকজনের সমস্যার কথাও আমাদের বিবেচনা করতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের চিরদিনের জন্য থাকতে হবে না, কারণ তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। রোহিঙ্গাদের এখনই স্থানান্তর করা হচ্ছে না। তাদের পাঠানোর আগে অবকাঠামো নির্মাণ ও জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে।

সর্বশেষ খবর