রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

লিটন হত্যায় কাদের খানের স্বীকারোক্তি

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

লিটন হত্যায় কাদের খানের স্বীকারোক্তি

গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলায় সাবেক এমপি ডা. কাদের খান নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার হেফাজতে ১০ দিনের রিমান্ডে থাকার কথা থাকলেও চার দিনের মাথায়ই জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিলেন তিনি। গতকাল দুপুর আড়াইটার  পর গাইবান্ধা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়নুল আবেদীনের আদালত ১৬৪ ধারায় তার এ জবানবন্দি রেকর্ড করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ার আগে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা মোবাইল ট্র্যাকিংয়ে তার কণ্ঠ শোনালে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। পরে তিনি খুনের ঘটনা সম্পর্কে তার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিতে সম্মত হন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর বাইরে সুন্দরগঞ্জে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়েও তার সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। খুনের ঘটনাটি অন্যদিকে প্রবাহিত করার একটি কৌশল ছিল তার। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকালে বগুড়া জেলা শহরের কাদের খানের গরীব শাহ ক্লিনিক থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি তার ১০ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেয় আদালত। রিমান্ডের চতুর্থ দিনে লিটন হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিলেন কাদের খান। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঠাণ্ডা মাথায় এমপি লিটনকে খুনের পরিকল্পনা করেন ডা. কাদের। সুনিপুণভাবে হত্যাকাণ্ড সম্পন্নের জন্য তার সুন্দরগঞ্জের বাসার তত্ত্বাবধায়ক শাহীনসহ রানা ও মেহেদীকে কাজে লাগান। সুন্দরগঞ্জের খানারপাড়ার বাড়িটিতেই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া তিনজনকে অস্ত্রে হাত পাকানোর কাজটি সম্পন্ন করান তিনি। এ জন্য তার নিজের অস্ত্রটি ব্যবহার করতে দেন কাদের খান। এ অস্ত্রটিও কিলিং মিশনে ব্যবহূত হয়েছিল। অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ তিন খুনির সার্বিক বিষয়ে ডা. কাদেরকে রিপোর্ট করার দায়িত্ব ছিল তার গাড়িচালক হান্নানের। এমপি কাদেরের ধারণা ছিল, শিশুকে গুলির ঘটনায় এলাকায় এমপি লিটনের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার পেছনে জঙ্গিদের হাত রয়েছে এলাকার মানুষের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে। এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের তদন্তও ওই দিকেই যাবে। এর আগে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অন্তত ১২৮ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ। আটকদের মধ্যে ২৩ জনকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এর মধ্যে কর্নেল কাদেরসহ মোট ১৫ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নে শাহবাজ (মাস্টারপাড়া) এলাকায় নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন এমপি মনজুুরুল ইসলাম লিটন। এ ঘটনায় লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী বাদী হয়ে অজ্ঞাত চার-পাঁচজনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন।

প্রতিমা ভাঙচুরে সম্পৃক্ততা : সুন্দরগঞ্জ জেএমবি প্রভাবিত এলাকা তা প্রমাণ করতে কাদের খান সুপরিকল্পিতভাবে নব্য জেএমবির নামে একাধিক মন্দির ও দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। এতে তিনি কাজে লাগান নিজ ভাতিজা ফয়সাল খান ফাগুনসহ কাজের লোকদের। সুন্দরগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী সাদুল্যাপুর উপজেলা এবং লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে নব্য জেএমবির নামে একাধিক মন্দির ও দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটান তিনি। ইতিপূর্বে এসব ঘটনায় কাদের খানের ভাতিজা ও তার বাড়ির কাজের লোক গ্রেফতার হয়। মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর কাদের খানের নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে বলে তারা স্বীকার করে। তবে মন্দিরের ভাঙচুরের সম্পৃক্ততার জন্য গ্রেফতার আসামিরা ইতিমধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়েছে।

সর্বশেষ ৯ অক্টোবর গাইবান্ধা সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুরে কামারপাড়া সড়ক-সংলগ্ন কালীমন্দিরের কালী প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এ অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটী ইউনিয়নের মণ্ডলের হাট থেকে ওই সময় কথিত নব্য জেএমবির সদস্য হিসেবে চারজনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে কাদের খানের ভাতিজা সুন্দরগঞ্জের ছাপড়হাটি ইউনিয়নের খানপাড়া পশ্চিম ছাপড়হাটি গ্রামের ইউসুফ খানের ছেলে ফয়সাল খান ফাগুন ছিল। এ ছাড়া কাদের খানের সুন্দরগঞ্জের পশ্চিম ছাপড়হাটি খানপাড়া গ্রামের বাড়িতে কর্মরত আবদুল ওয়াহাবের ছেলে নজরুল ইসলাম খান (৩৫), আবদুল হামিদ মিয়ার ছেলে আশিকুল ইসলাম (১৬) ও আদর আলীর ছেলে শহিদ মিয়া (১২) ওই সময় গ্রেফতার হয়। তারা মোটরসাইকেলে এসে মন্দিরের কালী প্রতিমা ভেঙে সেখানে নব্য জেএমবির দায় স্বীকার-সংক্রান্ত হাতে লেখা একটি চিঠি রেখে পালিয়ে যায়। এলাকাবাসী বলছেন, কাদের খান কোনো সময়ই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও সেভাবে মিশতেন না। ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সুন্দরগঞ্জ আসনের মনোনয়ন পান। নির্বাচিত হওয়ার পরও এলাকায় তেমন আসতেন না তিনি। বগুড়ার নিজস্ব ক্লিনিক ও বাড়িতেই থাকতেন তিনি। এলাকার লোকজনকে স্কুল-কলেজসহ নানা কাজে বগুড়াতেই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হতো। এলাকার বা দলের বিশ্বাসভাজন কাউকে না পাওয়ায় অপকর্মগুলোর সঙ্গে বাইরের বা দলের কাউকে সম্পৃক্ত না করে নিজ ভাতিজা ও বাড়ির কাজের লোকদের সম্পৃক্ত করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর