বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক ক্ষতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

আকস্মিক পরিবহন ধর্মঘটে সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুই দিনের ধর্মঘটে দেশের প্রায় সবকটি স্থল ও নৌবন্দর অচল হয়ে পড়ে। আমদানি করা মালামাল যেমন দেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারেনি, তেমনি রপ্তানি করা মালামালও যায়নি বাইরে। বেনাপোল, খুলনার মংলা, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, সাতক্ষীরার ভোমরা, টেকনাফ বন্দরে আমদানি-রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্যবাহী কয়েক হাজার ট্রাক আটকা পড়ে থাকে। এতে কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। বিশেষ করে কাঁচা মালবাহী পণ্য— পিয়াজ, কমলালেবু, আপেল, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে আমদানিকারকরা পড়েন চরম বিপাকে। ধর্মঘটে সরকার যেমন কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে, তেমনি বিপুল অংকের টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন আমদানি-রপ্তানিকারকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দিনের এই ধর্মঘটে ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।

শ্রমিকদের ডাকা এ ধর্মঘটের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারেও। ফলে মানুষের যাতায়াতই শুধু নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনেও বিঘ্ন ঘটে। তাই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ধর্মঘটের দুই দিন পার না হতেই বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ে শাক-সবজির মতো পচনশীল দ্রব্যের। এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদালতের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হতে পারে। কিন্তু এভাবে প্রতিবাদ করার কোনো নজির আমাদের দেশে আগে ছিল না। এখন এই নজির সৃষ্টি হলো। এটা খুব দুঃখজনক। তারচেয়ে বড় কথা ব্যবসা-বাণিজ্যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে সরকারের দ্রুত উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে ব্যবসায়ীরা রক্ষা পেলেন। বাজারে নেতিবাচক প্রভাব : ধর্মঘটের কারণে মালবাহী ট্রাকগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকা পড়ে আছে। ফলে রাজধানীতে ক্রেতা-বিক্রেতা নির্বিশেষে সবার একই অবস্থা। বিক্রেতারা বলছেন, ‘ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেশি দামে বিক্রি ছাড়া উপায় নেই তাদের।’ ক্রেতারাও উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে কিনতে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, পলাশীসহ বড়-ছোট সব বাজারেই এক অবস্থা। বরবটি, ঢেঁড়স, করলা, সিম, বেগুন, গাজর, আলু, কুমড়া, চিচিঙ্গা, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ সবকিছুরই দাম ৫/১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। লাল শাক, পুঁই, পালং, ডাঁটা শাকসহ সব শাকই কিনতেই আঁটি প্রতি ২ থেকে ৫ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বেনাপোল অচল : পরিবহন ধর্মঘটে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে দেশের অন্যতম স্থলবন্দর বেনাপোল। বন্দরে আটকা পড়ে থাকে শতাধিক ট্রাক। আর এসব ট্রাকে আছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। ট্রাকে থাকা মাছ, পিয়াজে পচন ধরেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিবহন ধর্মঘটের কারণেই বেনাপোলের এ হাল! আমাদের বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আসা ট্রাকচালক কে বাসাই জানান, ধর্মঘটের কারণে তিন দিন ধরে তার মাছের ট্রাক খালি হচ্ছে না। তার মাছ পচে যাচ্ছে। দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। তার কাছে টাকা-পয়সাও বিশেষ নেই। অন্য চালকদের কাছ থেকে ঋণ করে খাওয়া-দাওয়া করতে হচ্ছে। পারমোজিত সিংহ নামের অপর এক ভারতীয় ট্রাক চালক জানান, তিনি পিয়াজের ট্রাক নিয়ে বন্দরে অবস্থান করছেন। তার পিয়াজ নষ্ট হওয়ার পথে। তিনি এখন ট্রাকের ত্রিপল খুলে দিয়ে আলো-বাতাস দিচ্ছেন পিয়াজে। কাস্টমস সূত্র জানায়, ধর্মঘটে বেনাপোল বন্দর থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। বন্দর থেকে পণ্য না গ্রহণ করায় সড়কের দুই পাশে শতাধিক ট্রাক আটকা পড়েছে। সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় বিদেশি মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশ। আমদানিকারকরা অতিরিক্ত ভাড়া দিচ্ছেন। খুলনায় ক্ষতি শত কোটি টাকা : খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, খুলনায় পরিবহন ধর্মঘটে কৃষি, জ্বালানি খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকার।

ধর্মঘটের কারণে খুলনার পাইকারি বাজারগুলোতে পণ্য বেচাকেনা বন্ধ ছিল। ইরি-বোরোর ভরা মৌসুমে কৃষকের মাঝে জ্বালানি তেল ও সার সরবরাহ করা যায়নি। মংলা বন্দরে জাহাজ থেকে মালামাল খালাস হলেও দেশের কোথাও তা সরবরাহ হয়নি। খুলনা থেকে চিংড়ি, হিমায়িত খাদ্য ও পাট রপ্তানিতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম জানান, ধর্মঘটের কারণে মংলা বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া স্বল্প সংখ্যক পণ্য খালাস হলেও পরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের কোথাও তা সরবরাহ করা যায়নি। তিনি বলেন, ধর্মঘটের কারণে স্থবিরতায় বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষি, চিংড়ি, হিমায়িত খাদ্য ও পাট রপ্তানিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। 

খুলনার সোনাডাঙ্গা পাইকারি কাঁচা বাজারের সাধারণ সম্পাদক এ এম এম মঈনুল ইসলাম নাসির জানান, ধর্মঘটের কারণে পাইকারি কাঁচাবাজারগুলোতে চার দিনে গড়ে ২০ কোটি টাকার লেনদেন হয়নি। এ অঞ্চলের বৃহৎ ব্যবসা কেন্দ  খুলনা বড় বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। খুচরা বাজারে পণ্যের সরবরাহ না থাকায় এরই মধ্যে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। খুলনা ধান-চাল বণিক সমিতির সভাপতি আলহাজ মুনীর আহমেদ জানান, ধর্মঘটে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন কাঁচামাল আমদানিকারকরা। ধর্মঘটের কারণে বড় বাজার-কালিবাড়ি এলাকায় স্থবিরতার সৃষ্টি হয়।  

জানা গেছে, ধর্মঘটের কারণে পর্যটনের ভরা মৌসুমে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে সুন্দরবন। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটন শিল্পও। খুলনা বিভাগীয় ট্যাংক লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরহাদ হোসেন জানান, ইরি-বোরোর ভরা মৌসুমে প্রতিদিন সেচকাজের জন্য প্রায় ৪০ লাখ লিটার ডিজেলের চাহিদা থাকলেও ধর্মঘটের কারণে তা বন্ধ ছিল। পেট্রল পাম্পগুলোতে তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে এ খাতে ক্ষতি ১০ কোটি টাকার মতো।

ভোমরা স্থলবন্দর : সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানিকৃত শতাধিক কাঁচামাল ভর্তি ট্রাকসহ ৫ শতাধিক বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়ে থাকে। এতে আমদানিকৃত কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। বিশেষ করে কাঁচা মালবাহী পণ্য— পিয়াজ, কমলালেবু, আপেল, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল আমদানিকারকরা পড়েছেন চরম বিপাকে।

ধর্মঘটের কারণে বন্দরে মাল খালাসের জন্য একটি ট্রাক থেকে অন্য ট্রাকে লোডিং-আনলোডিং না হওয়ায় তিন হাজারের মতো শ্রমিকের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তিন দিনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিকরা।

ভোমরা সিএন্ডএফের সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান নাছিম জানান, পরিবহন ধর্মঘট ও পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে ভোমরা স্থলবন্দর। শত কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন আমদানি-রপ্তানিকারকরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর