বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

জঙ্গি নিয়ে হঠাৎ নিরাপত্তা হুমকি

কুমিল্লায় পুলিশ-জেএমবির মুখোমুখি সংঘর্ষ, শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার

সাখাওয়াত কাওসার

জঙ্গি নিয়ে হঠাৎ নিরাপত্তা হুমকি

পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারে জঙ্গি। পরে তাকে আটক করা হয়। আটক সহযোগী হাসান —বাংলাদেশ প্রতিদিন

টঙ্গীতে নিষিদ্ধ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) শীর্ষ নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টার ১৩ ঘণ্টার মধ্যে কুমিল্লায় আবারও জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই গতকাল বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লার চান্দিনায় গ্রেনেড ও ছুরিসহ জসিম (২২) ও হাসান (২৪) নামের       যুবককে আটকের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। তারা বলছেন, আটক দুই যুবক নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার গ্রেনেডগুলো এযাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রেনেড। দুই কেজি ওজনের একেকটি গ্রেনেড দিয়ে বড় ধরনের হামলা করা সম্ভব। পর পর দুটি ঘটনায় হঠাৎ নিরাপত্তা হুমকিতে উদ্বিগ্ন খোদ গোয়েন্দারা।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার হাজিরা শেষে সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীসহ ১৯ আসামিকে প্রিজন ভ্যানে করে পুনরায় কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় প্রিজন ভ্যান লক্ষ্য করে হাতবোমা ছোড়ে জঙ্গিরা। তবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেগুলো রাস্তায় পড়ে বিস্ফোরিত হয়। বোমা বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় মোস্তফা কামাল নামের এক যুবককে ব্যাগভর্তি ককটেল এবং নগদ সাড়ে সাত হাজার টাকাসহ আটক করেন পুলিশ সদস্যরা। গতকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গাজীপুর জেলা পুলিশ।

জঙ্গি নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টঙ্গী ও কুমিল্লার ঘটনা এবং দুই জঙ্গির কাছ থেকে উদ্ধার শক্তিশালী গ্রেনেডগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে ভয়ংকর কোনো ঘটনার। গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন তারা।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘আমরা বলিনি জঙ্গি নির্মূল করেছি। শিকড় উপড়ে দিয়েছি এটা বলিনি। আমরা বলছি আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি।’

জঙ্গিবাদকে দেশের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই এরা (জঙ্গি) বসে থাকবে না, এরা মাঝেমধ্যেই আত্মপ্রকাশ করবে। আমরা মনে করি, জনগণ যখন আমাদের সঙ্গে আছে, কেউ আমাদের অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।’ গতকাল রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

গত বছর হলি আর্টিজান হামলার পর টানা অভিযানে জঙ্গিদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এমনটাই মনে করেছিলেন গোয়েন্দারা। মাঝখানে কিছুটা সময় নীরব থাকলেও আবার নতুন করে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। তৎপর হয়ে উঠছে নিষিদ্ধ সংগঠনের দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা। কারাবন্দী শীর্ষ জঙ্গিদের ছিনতাই প্রচেষ্টার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। হামলে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত পুলিশের ওপর। কড়া নিরাপত্তা থাকার পরও জঙ্গিদের এমন তৎপরতা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গতকাল বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ ফাঁড়ির সার্জেন্ট কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ওই অভিযান চলাকালে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের অধিক গতি চিহ্নিত হয়। পুলিশ গাড়িটি ধাওয়া করে আটক করার পর বাস থেকে নেমে আসা যাত্রীবেশী দুই জেএমবি সদস্য ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে। কিন্তু ভাগ্যবশত ওই বোমা বিস্ফোরিত না হয়নি। পুলিশ এ সময় ধাওয়া করলে তারা বোমা ছুড়তে ছুড়তে দৌড়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা ২৪ রাউন্ড গুলি ছুড়ে গুলি ছোড়ে। প্রায় ২০ মিনিটের চেষ্টায় এলাকাবাসীর সহায়তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জসিম ও হাসান নামে দুই জেএমবি সদস্যকে আটক করে হাইওয়ে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে চারটি বোমা ও এক১িট ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়। পরে উদ্ধার করা হয় আরও একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। জঙ্গি হামলা ও গ্রেনেড উদ্ধারের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে বোম্ব ডিসপোজেবল ইউনিটসহ ছুটে যান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। তারা বলছেন, ‘আটকদের সঙ্গে কথা বলে আমরা অনেকটাই নিশ্চিত তারা নব্য জেএমবির সদস্য। আটক জেএমবি সদস্য হাসান চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার শান্তির হাট গ্রামের মৃত মোহাম্মদ হোসাইনের ছেলে। অপর জঙ্গি জসিমের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।

সিটিটিসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ জানান, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একেকটি গ্রেনেডের ওজন দুই কেজির মতো। এসব গ্রেনেড দিয়ে দোতলা বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা গতি নিয়ন্ত্রণে গাড়িটি ধাওয়া করলেও বাসে থাকা জেএমবি সদস্যরা তাদের সন্দেহ করে আটকের বিষয়টি ভেবে আমাদের ওপর হামলার চেষ্টা করে। গুলিবিদ্ধ জেএমবি সদস্য জসিমকে চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। অপর জেএমবি সদস্য হাসানকে পুলিশ হেফাজতে চান্দিনা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্রমতে, ময়মনসিংহের ত্রিশালের ঘটনার আদলে হুজিবির শীর্ষ নেতা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরিফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুলকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়। পুলিশ এ ভয়ংকর পরিকল্পনার বিষয়টি জানতে পারে সম্প্রতি রাজধানীর শাহজাহানপুর ও মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেফতার সালেহ, মাহমুদ ও জাভেদের কাছ থেকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই তারা জানিয়েছিল, এ পরিকল্পনায় তাদের সঙ্গে আরেক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) একটি অংশও জড়িত। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জানুয়ারি মাসে দুই জঙ্গি কাশিমপুর কারাগার এলাকা রেকি করে। সালেহ ছাড়াও মুফতি হান্নান ও বিপুলকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় যুক্ত হয়েছিল জঙ্গি সালমান ও জুনায়েদ। জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল জুনায়েদ। সে তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। জুনায়েদ আত্মীয় পরিচয়ে আপেল নিয়ে কারাবন্দী বিপুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল। সে বর্তমানে এবিটির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আগে হুজিবির সদস্য ছিল। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটে। হুজিবির পুরনো সদস্য জুনায়েদ ও এবিটির সদস্য সালমানের পরিকল্পনামাফিক মুফতি হান্নান ও বিপুলকে ছিনিয়ে নিতে মাহমুদ ও জাভেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার বিষয়টি জানার পর তার জন্য নিরাপত্তা বাড়াতে বলা হয়েছিল। এ কারণে তাকে ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে জঙ্গিরা। তবে গ্রেফতার মুস্তফা কামালের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা সম্ভব হয়নি।

কুমিল্লায় হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আটক দুই জঙ্গিকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা মুখ খোলেনি। তবে তাদের যে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল এটা নিশ্চিত। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে তিন জঙ্গি রাকিব, বোমা মিজান ও সালেহীনকে ছিনিয়ে নেয় জামাআতুল মুজাহিদিন অব বাংলাদেশ (জেএমবি)।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মিজানুর রহমান বলেন, মুফতি হান্নানসহ দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় যে কোনো সময়ের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন বেশি সতর্ক। তাদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানের সামনে-পেছনে একাধিক টিম থাকে।

সর্বশেষ খবর