বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

তৃণমূল নারীর বিশ্বজয়

জিন্নাতুন নূর


তৃণমূল নারীর বিশ্বজয়

বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার নারী তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। উচ্চশিক্ষিত নারী তার কর্মদক্ষতার মাধ্যমে দেশ গঠনে যেমন দায়িত্ব পালন করছেন। একইভাবে তৃণমূলের নারীও জিডিপিতে অবদান রাখছেন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি তারা খেত-খামারের কাজ ও কৃষিকাজে স্বামীকে সহায়তা করছেন। এমনকি মাঠ-ঘাটের শক্ত কাজ যেমন— সড়ক নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরিতেও এই নারীরা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন গ্রামের নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত নারীও। আবার সেই তৃণমূলের নারীরাই বিশ্ববাজারে নিজেদের তৈরি পণ্য দিয়ে ক্রেতার মন জয় করছেন। তাদের এই নারীদের তৈরি পুতুল, শোপিস এবং টুপিসহ নানা রকম পণ্য তাদের সংসারের সচ্ছলতা ফেরানোর পাশাপাশি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর মাধ্যমে একদিকে বিশ্ববাজারে দেশজ পণ্য সামগ্রীর কদর বাড়ছে অন্যদিকে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানও। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেশের কয়েকটি এলাকার তৃণমূলের নারীদের বিশ্বজয়ের ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো। বরিশালের আগৈলঝাড়ার প্রায় দুই হাজার নারী সদস্যের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি)। এর উদ্যোগে আগৈলঝাড়া উপজেলার পাঁচটি কেন্দ্রে দুস্থ ও বিধবা নারীরা এখন পরিত্যক্ত ডোবা ও পুকুরের কচুরিপানা থেকে বিশেষ ভাবে নির্মিত কাগজ দিয়ে বড়দিন ও জন্মদিনসহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের সাজানো সামগ্রী ও উপহার তৈরি করছেন। এই সংস্থার মাধ্যমে তৈরি করা শৌখিন খেলনা ও উপহার সামগ্রী ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপানে রপ্তানি করা হচ্ছে। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। জানা যায়, এসব তৈরি করে প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিক সাড়ে তিনশ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এই নারীদের মধ্যে অনেকেই আছেন স্বামী পরিত্যক্তা ও অসহায়। এই উপজেলার জোবারপার এন্টারপ্রাইজ, কালুরপাড়ের বিবর্তন, বড়মগরার কেয়া পাম হ্যান্ডিক্রাফটস, নগরবাড়ীর চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ও বাগধা এন্টারপ্রাইজে প্রতি বছরই নতুন নতুন উপহার সামগ্রী তৈরির কাজ করা হয়। এ ব্যাপারে বিবর্তন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সজল দাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানে তৈরি ৯০ শতাংশ পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বছরে এসব পণ্য রপ্তানি করে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা আয় হচ্ছে। মূলত সমাজের অবহেলিত, অসহায় ও পরিত্যক্ত নারীদের জীবনে সচ্ছলতা আনতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ বাগেরহাটের তৃণমূলের নারীদের বিশ্বজয়ের আরেক উদাহরণ দেওয়া যাক। এখানে নারিকেলের মালা বা আঁচা দিয়ে তৈরি হচ্ছে গয়নাসহ বিভিন্ন পণ্য এখন হংকং, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, লন্ডন, জাপান ও উত্তর কোরিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে। নারিকেলের ফেলে দেওয়া জিনিসে তৈরি এসব রপ্তানি পণ্য থেকে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে বহু নারীর। বাগেরহাটের বিসিক শিল্পনগরীতে ২০১১ সালে নূরজাহান এগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড স্থাপিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের পাশাপাশি ‘কোকো সেল বাটন ইউনিট’ নামে একটি নারিকেলের মালা দিয়ে বোতাম তৈরির কাজ শুরু করে। দেশ-বিদেশে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বোতামের পাশাপাশি নারিকেলের মালা দিয়ে জুয়েলারি সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন শুরু করে এখানকার নারীরা। এর মধ্যে আছে চুড়ি, কানের দুল, হ্যান্ডব্যাগ, পার্টসব্যাগ, ওয়ালম্যাটসহ বিভিন্ন শোপিস। একজন নারী প্রতিদিন ২০ হাজার বোতাম তৈরির বিনিময়ে ২০০ থেকে আড়াইশ টাকা পারিশ্রমিক পান। স্থানীয় সূত্র জানায়, এসব পণ্য তৈরিতে বাগেরহাটের প্রায় ২০০ নারী জড়িত। শুধু নারিকেলের আঁচা সংগ্রহেই আছে ৮০ থেকে ৯০ জন। তারা আঁচা সংগ্রহ করে তা কারখানায় ব্যবহার উপযোগী করে পণ্য তৈরি করেন।

তৃণমূলের আরেক বিশ্বজয়ী নারী হলেন দিনাজপুরের কৃষকনেতা সাজেদা বেগম। বিশ্বের ১৬টি দেশের ২০টি সংগঠনের প্রায় এক লাখ কৃষকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের এই কৃষকনেতা সাজেদা। দিনাজপুরের এই নারী কৃষক এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই প্রথমবারের মতো এই সংগঠনে কোনো নারী ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেলেন তাও আবার বাংলাদেশি নারী! এ পদে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পরে আবার এই অ্যাসোসিয়েশনেরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরও দুই বছর সাজেদার দায়িত্ব পালনের কথা। তবে এই দায়িত্ব পালনের আগে সাজেদাকে গ্রাম, ইউনিয়ন ও কেন্দ্রীয় কৃষক সংগঠনের নেতৃত্বে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে হয়েছে। দেশের ২২ হাজার কৃষক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রীর প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন সাজেদা। এই সংগঠনেরও নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি প্রথম দায়িত্ব পালন করেন। এই নারী কৃষক কর্মসূত্রে এরই মধ্যে ফিলিপাইন, মিয়ানমার, ব্যাংকক, ভিয়েতনাম ও নেপালে সফর করেছেন। জানা যায়, দেশ-বিদেশে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নিজের এক একর জমিতে ফসল বোনা, সবজি রোপণ, পাইকারের কাছে ফসল বিক্রি ও বাড়ির কাজসহ বীজ ব্যবস্থাপনা, কৃষকদের অধিকার আদায় নিয়ে আলোচনাসহ নিজ সংগঠনের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বিয়ের পর সরকার পরিচালিত কৃষক মাঠ স্কুলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পান সাজেদা। ২০১২ সালে অ্যাকশন এইডের দিনাজপুরে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বশীল কৃষি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। সেখান থেকেও নারী নেতৃত্ব বিকাশ, ব্যবসা সংক্রান্ত নানা প্রশিক্ষণ পান তিনি। ফিলিপাইনে ‘ইয়ুথ ফার্মার’ হিসেবে পারিবারিক কৃষি নিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সাজেদার স্বপ্ন একসময় বাংলাদেশে এমন কৃষকনেতা তৈরি হবে যে কৃষকনেতা বিশ্বের শুধু ১৬টি দেশ নয়, সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দেবেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের নারীদের তৈরি খেলনা এখন জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে পশ্চিমা শিশু ও তার অভিভাবকদের মন জয় করছে। ‘পেবেল’ নামে নারীদের হাতে বোনা এই পরিবেশবান্ধব খেলনা গুণগত মানের কারণে এরই মধ্যে ওয়ার্ল্ড ফেয়ার ট্রেড অর্গানাইজেশন সনদ (ডব্লিউএফটিও) পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার আট হাজারের বেশি নারী এই খেলনাগুলোর তৈরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পেবেল-এর যাত্রা শুরু হয় সামান্তা মোর্শেদের মাধ্যমে। তার সহযোগিতায় গ্রামের যেসব নারী ঘরের বাইরে গিয়ে নিজে অর্থ উপার্জনের কথা কখনো ভাবতে পারেননি, তারাই আজ নিজেদের পরিবারের দারিদ্র্য দূর করছেন পুতুল তৈরি করে। আর সেই পুতুল ও খেলনা দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে চলে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন শিশুদের হাতে। গ্রাম-বাংলার নারীদের হাতে তৈরি রঙিন ও ব্যতিক্রমী পুতুলগুলো হাসি আনছে পশ্চিমা শিশুদের মুখে। যাত্রার শুরুতে স্থানীয় একটি এনজিও মাধ্যমে তিনি প্রথমে বেশ কয়েকজন নারীকে ঢাকায় তার বাসায় উল ও কাপড় দিয়ে পুতুল তৈরি করার কৌশল শেখান। ২০১০ সাল থেকে এই পুতুলগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করার পক্রিয়ায় যান সামান্তা। সে বছর ‘পেবেল’-ব্র্যান্ড নামে আরও বৃহত্তর আঙ্গিকে ইউনাইটেড কিংডম ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলার নারীদের তৈরি পুতুল বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয়। সারাবিশ্বে এখন পেবেল ব্র্যান্ডের পুতুলগুলো ১৭টি বিপণনকারীর মাধ্যমে বিশ্বের ৩৭টি দেশে বিক্রি করা হচ্ছে। সামান্তা মোর্শেদ বলেন, পেবেল বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র ডব্লিউএফটিও সনদপ্রাপ্ত হাতে তৈরি খেলনার ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের কারুশিল্পের প্রসারের জন্য এটি বড় অর্জন।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক রাহাত খান এবং বাগেরহাটের স্থানীয় প্রতিনিধি আহসানুল করিম ও দিনাজপুরের স্থানীয় প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর