শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
আগুনঝরা মার্চ

১০ মার্চ ফরিদপুরে জনসভা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াই

শাহ মো. আবু জাফর

১০ মার্চ ফরিদপুরে জনসভা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াই

১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন করতে দিলেন না। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে এক বিশাল ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে এটা বুঝতে আর কারও কাছে বাকি রইল না। আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশের ডাক দিল। ১৯৭১ সালে ১ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন চত্বরে এক বিশাল ছাত্র গণজমায়েতে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের গণজমায়েতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা সেখানে আবার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ঢাকা থেকে জেলা ছাত্রলীগের কাছে নির্দেশ এলো, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক, জেলা সদরের কেন্দ্রীয় ও প্রধান কলেজের ভিপি-জিএসকে নিয়ে প্রত্যেক জেলায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে হবে। ওই নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ১ মার্চ ফরিদপুরে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলাম। এই পরিষদের সদস্য হলাম আমি, সৈয়দ কবিরুল আলম মাও, সালাহউদ্দিন আহমেদ। এখানে চারজনের স্থলে তিনজন হওয়ার কারণ আমি একই সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজেন্দ্র কলেজের ভিপি ছিলাম। ৩ মার্চ ফরিদপুর জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ফরিদপুর শহরে বিশাল মিছিলে গগনবিদারী আওয়াজ উঠল, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, স্বাধীন বাংলা কায়েম কর। তুমি কী আমি কী, বাঙালি-বাঙালি। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা। এই মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করে রাজেন্দ্র কলেজের আমতলায় এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে যে সমাবেশ হয় সে সমাবেশে ভিপি হিসেবে আমিই সভাপতিত্ব করি। সভায় বক্তব্য রাখেন নাসিরউদ্দিন আহমেদ মুসা, সৈয়দ কবিরুল আলম মাও, নাসিরউদ্দিন আহমেদ খোকন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবু সাঈদ খান, বাহলুল মজনুন চুন্নু, এম এম শাহরিয়ার রুমি প্রমুখ ছাত্র নেতারা। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু অগ্নিঝরা বক্তব্য শোনার পর সিদ্ধান্ত হলো ১০ মার্চ অম্বিকা ময়দানে বিশাল ছাত্র জমায়েত করতে হবে। এই সমাবেশ থেকে জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি ঘোষণা করলাম ফরিদপুরের প্রশাসন আর পাকিস্তান সরকারের কথা মতো চলবে না। প্রশাসনের সবাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হবে। এর বাইরে কেউ যদি বাংলার মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার চেষ্টা করেন তাহলে সেই অফিসারকে জনতার আদালতে হাজির করে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বিচার করা হবে। ঘোষণা করলাম ফরিদপুরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নামে কোনো রাস্তা, প্রতিষ্ঠানের নাম থাকতে পারবে না। আজ হতে ফরিদপুরের জিন্না এভিনিউয়ের নাম হবে শেখ মুজিব সড়ক, আযম মার্কেটের নাম হবে তিতুমীর বাজার, কায়েদে আযম লাইব্রেরির নাম হবে শেরেবাংলা পাঠাগার আর টেপাখোলা লেকপাড়ের নাম হবে সোহরাওয়ার্দী সরোবর। আমি বললাম, ডিসি, এসপি অফিসে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। সেখানে গিয়ে আমরা পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে আসব। উত্তাল ছাত্র-জনতাকে বললাম আপনারা রাজি আছেন? গগনবিদারী আওয়াজ হলো, হ্যাঁ আমরা রাজি আছি। যে কথা, সেই কাজ। আশরাফুজ্জামান মজনুকে কয়েকটি স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করে সভায় নিয়ে আসতে বলেছিলাম। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলার একটি পতাকা অম্বিকা ময়দানে লাখো মানুষের দুনিয়া কাঁপানো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানের মধ্যদিয়ে উত্তোলন করি। অন্য কয়টি পতাকার একটি ডিসি অফিস থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হলো। এসপি অফিসেও অনুরূপ পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। একটি পতাকা নিয়ে আমরা সার্কিট হাউসের পূর্ব গেটে অবস্থান নিলাম। হাজার হাজার মানুষ সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, পাকিস্তানের সৈন্যরা সার্কিট হাউসের ছাদে এবং বিভিন্ন অবস্থানে বালির বস্তা দিয়ে নিরাপদ অবস্থান তৈরি করে পজিশন নিয়ে আমাদের দিকে এলএমজি তাক করে বসে আছে।  পূর্ব গেটের কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে ধরল। উর্দুতে বলল, কোনো প্রকার গেটের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে আমরা গুলি চালাতে বাধ্য হব। আমি বললাম, তোমাদের সঙ্গে আমরা কোনো সংঘাত করতে আসিনি। আমরা পাকিস্তান মানি না। এই সার্কিট হাউস এখন ফরিদপুরের মাটিতে আর এটা এখন বাংলাদেশ। তাই সার্কিট হাউসের ওপর যে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে সেটা নামিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াতে চাই। তারা বলল, এটা পাকিস্তান আর আমরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। অতএব এখানে আমরা এ পতাকা কিছুতেই উড়াতে দেব না। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা জোর করেই সার্কিট হাউসের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই একজন অফিসার এসে বলল, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতির জন্য যাই, আপনাদের ব্যাপারে তিনি কী বলেন একটু শুনে আসি। ওই লোকটি সার্কিট হাউসের ভিতরে প্রবেশ করতেই বাঁশির কড়া হুইসেল শুনতে পেলাম। শুরু হয়ে গেল লাঠিচার্জ, রাইফেলের বাটের আঘাত। মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল আমাদের লোকজন। আমার হাতে ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। আমাকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে, বুট দিয়ে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। আমি প্রায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম। এমন সময় কয়েকজন মার খেয়েও আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে সরিয়ে নিল। আমি পড়ে যাওয়ার পর আমার হাত থেকে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী পতাকাটি হাতে নিয়ে একটু দূরে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। সে জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, জীবন থাকতে পতাকার মর্যাদা নষ্ট হতে দিব না। আমি তাকিয়ে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীকে পাকিস্তান আর্মিরা পায়ের বুট দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে। আমি সেই মুহূর্তে কয়েকজন কর্মীকে বললাম, ত্রিবেদী দা’কে রক্ষা কর। তারা ছুটে গিয়ে ত্রিবেদীকে পতাকাসহ ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো। এ ঘটনায় অনেকে জখম হলো, আঘাতপ্রাপ্ত হলো। জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে ফরিদপুরের ডিসি, এসপিকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো, বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে চলে যেতে বলেছেন। অতএব ফরিদপুরে যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করেছে তাদেরকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট চলে যেতে হবে নচেত্ আমরা আরও কঠিন কর্মসূচি হাতে নিতে বাধ্য হব। এসব মিলিয়ে ১৭ মার্চ ফরিদপুর সার্কিট হাউস থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেনা সদস্যরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট চলে গেল। পরবর্তী সময়ে ২১ এপ্রিল আকাশপথ, স্থলপথ, জলপথে ফরিদপুরে পাকিস্তান সেনারা আক্রমণ চালিয়ে ফরিদপুর দখল করে নেয়। এর আগ পর্যন্ত আমাদের উত্তোলিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ফরিদপুরের শহরে, গ্রামগঞ্জে উড়তে থাকে। লেখক : সাবেক এমপি, বিএলএফ কমান্ডার, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা

সর্বশেষ খবর