বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রবিহীন সংবাদপত্র কল্পনা করা যায়, সংবাদপত্রবিহীন রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

রাষ্ট্রবিহীন সংবাদপত্র কল্পনা করা যায়, সংবাদপত্রবিহীন রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ আট বছরে পা দিল। এখন সময়ের যা গতি এবং প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যে অত্যাশ্চর্য বিকাশ, তাতে আট বছরের বালক এখন সত্তর বছর বয়সের মানুষের অভিজ্ঞতার অধিকারী হতে পারে। কেবল প্রাচীনত্ব এখন ঠুনকো। তাই ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ কাগজটির বয়স আটে পা দিলেও তার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ও মেধার দ্বারা পুষ্ট। জনশ্রুতি, এই পত্রিকাটিই বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক। এই দৈনিকটির পাঠকপ্রিয়তা থেকেই অনুমান করি, তার পাঠকদের প্রতিদিনের মনের খোরাক সে জোগাতে পারছে। বাংলাদেশের এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর জন্ম যখন দেশটির আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে চলছে ‘নিত্য নিষ্ঠুর দ্বন্দ্ব।’ এই দ্বন্দ্ব-সন্ত্রাসের মাঝখানে পাঠককে রোজ সঠিক খবরটি পৌঁছে দেওয়া, নিরপেক্ষ খবর ভাষ্য প্রচার একটি দুরূহ কাজ। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এই দায়িত্বটি পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই তার এই জনপ্রিয়তা। নিরপেক্ষতার নামাবলি গায়ে চড়িয়ে পাঠক ঠকানোর ব্যবস্থা সৎ সাংবাদিকতা নয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন এই পাঠক ঠকানোর সাংবাদিকতা করে না বলেই তার অষ্টম জন্মদিনে তাকে সাধুবাদ জানাই। গত বছর এই পত্রিকাটি তাদের কার্যালয়ে আমাকে সাংবাদিক হিসেবে সম্মাননা দানের একটি অনুষ্ঠান করেছিল। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের এই সম্মাননা গ্রহণ করেছি। অনুষ্ঠানে এই পত্রিকা গোষ্ঠীর যিনি প্রধান কর্ণধার তিনি একটি মন্তব্য করেছিলেন, যা আমার এখনো স্মরণ আছে। তিনি বলেছিলেন, এই পত্রিকায় যেসব সাংবাদিক কাজ করতে আসেন, তাদের আমি একটা কথাই বলি, ‘যত অপ্রিয় হোক সত্য খবর লিখুন। কোনো কারণেই অসত্যের প্রশ্রয় দেবেন না।’ এ যুগে বাংলাদেশের একজন মিডিয়া মুঘলের কণ্ঠে এ ধরনের কথা আমাকে চমত্কৃত করেছে। মনে আশা হয়েছে, আমাদের সাংবাদিকতা পশ্চিমা অনেক উন্নত দেশের মতো এখনো কানাগলিতে একেবারে ঢুকে যায়নি। মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন কায়েদে আযম নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন ডিকটেটোরিয়াল স্বভাবের মানুষ। অবিভক্ত ভারতে সংবাদপত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনিও সৎ সাংবাদিকতাকে কতটা গুরুত্ব দিতেন তা এখনো অনেকে স্মরণ করেন। চল্লিশের দশকে জিন্নাহ যখন দিল্লি থেকে (পরবর্তীকালে করাচি থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো) ডন (উঅডঘ) নামে একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ নেন, তখন একজন ভালো সম্পাদকের খোঁজ করেন। জিন্নাহ ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যানের নিয়মিত পাঠক ছিলেন। এই কাগজে ‘কাফির’ ছদ্মনামে একটি কলাম লিখতেন একজন বাঙালি সাংবাদিক আলতাফ হোসেন।

তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকারে তথ্য ও প্রচার বিভাগে চাকরি করতেন। জিন্নাহ তাকেই ডনের সম্পাদক করার জন্য ডেকে পাঠান। ইন্টারভিউর সময় আলতাফ হোসেনকে জিন্নাহ বলেছিলেন, তুমি তোমাদের কায়েদে আযমকেও দরকার হলে সমালোচনা করতে পারবে তো? আলতাফ হোসেন বলেছিলেন, পারব। তার চাকরি ‘ডনে’ পাকা হয়ে গিয়েছিল। এখন উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে অধিকাংশ দেশেই স্বাধীন সম্পাদক একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। বহু কাগজে মালিকই সম্পাদক। তিনি নিজে সাংবাদিক হলে ভালো। না হলে কাগজের সাংবাদিকদের কপালে নানা বিড়ম্বনা জোটে। বাংলাদেশে আগে রাজনীতিকরা কাগজ চালাতেন। এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের মালিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এতে সাংবাদিকদের দল-নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করার সুযোগ একটু বেড়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী স্বার্থ-দ্বন্দ্বের আবর্তেও তাদের পড়তে হচ্ছে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের জন্য তাই এখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েও সংবাদপত্র যে এখনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য প্রধান স্তম্ভ এটাই আমাদের ভরসা। এক মনীষী বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রবিহীন সংবাদপত্র কল্পনা করা যায়, কিন্তু সংবাদপত্রবিহীন রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না।’ এ যুগে এ কথাটির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন যুগে যখন সংবাদপত্র ছিল না, তখন সাধারণ মানুষ কোনো তথ্য জানতে পারত না। অন্ধভাবে রাজাদেশে চালিত হতো। তাদের নাগরিক অধিকারবোধ ছিল না। নাগরিক ও সামাজিক অধিকারবঞ্চিত সাধারণ মানুষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো আন্দোলন করারও সুযোগ ছিল না। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার, সংবাদপত্র প্রকাশ, অবাধ তথ্যপ্রবাহ বিশ্ব রাজনীতির চেহারা বদলে দিয়েছে। সংবাদপত্র মানুষের মনে অধিকারবোধ জন্ম দিয়েছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সংবাদপত্র এখনো অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যেও সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বার্থের পাহারাদার। বাংলাদেশে আমরা সংবাদপত্রের এক বিশেষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করেছি। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশে যখন পার্লামেন্ট প্রায় অচল এবং নির্বাচিত সরকারের আমলেও পার্লামেন্ট বিরোধী দল শূন্য; তখন জনগণের হয়ে কথা বলার জন্য সংবাদপত্রকেই পার্লামেন্টের ভূমিকাও পালন করতে দেখা গেছে। এই সময়ে কোনো কোনো সংবাদপত্রকে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করতে দেখা গেছে। এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বহু সম্পাদক নির্যাতিত হয়েছেন, বহু সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। তবুও বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জনগণের পাশে সংবাদপত্র সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে সাহসী ও সংগ্রামী সাংবাদিকতার একটা উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এই ইতিহাসে চার সম্পাদকের নাম নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী এবং কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। বাংলার মানুষের ভাষা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত এই সাংবাদিকদের অবদানের কোনো তুলনা নেই। বাংলা সাংবাদিকতার আরেকজন পথিকৃৎ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও এদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। কারণ, তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বাংলাদেশে সাংবাদিকতাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। আধুনিক প্রযুক্তি তাকে দিয়েছে নতুন চেহারা এবং উন্নত মান। এই সাংবাদিকতায় সংকীর্ণতা ঘুচে গেছে এবং আন্তর্জাতিকতা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানের গ্লোবাল ভিলেজে এখন আর কোনো দূরত্ব নেই। মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর আরেক প্রান্তে পৌঁছে যায়। চিলিতে ভূমিকম্প হলে তার খবর সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারে বাংলার মানুষ। দুর্গত মানুষের জন্য বিশ্বজনীন সহমর্মিতা তৈরি হয়। সংবাদপত্র বিশ্বমানবতার জন্য একটি সেতুবন্ধ। এর ভালো দিকের সঙ্গে একটি মন্দ দিকও আছে। অসৎ সাংবাদিকতা মানুষের সর্বনাশ করে। ভুল খবর প্রচার, খবরের অসাধু বিশ্লেষণ দ্বারা জনমত বিভ্রান্ত করা ইত্যাদি নানা অভিযোগ আছে একশ্রেণির মিডিয়ার বিরুদ্ধে। অবিভক্ত ভারতে অসত্য খবর প্রচার দ্বারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর উদাহরণ আছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল্যবোধের বিকাশ এবং স্বৈরাচারী ও মৌলবাদী চক্রকে সহায়তাদানের জন্য নিরপেক্ষতার আবরণে একশ্রেণির সংবাদপত্রকেও সময় সময় সক্রিয় হতে দেখা গেছে। এতে সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার মোকাবিলায় এরা কখনো জয়ী হতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আমি এ জন্যই জন্মদিনের অভিনন্দন জানাই, এ কাগজটির স্বাধীন সম্পাদনা ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার একটা সুনাম আছে। হলুদ সাংবাদিকতার কোনো কলঙ্ক এখন পর্যন্ত এই কাগজটিকে স্পর্শ করেনি। জনগণের হয়ে কথা বলার সাহস তার আছে। ফলে তার জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। স্বাধীনতার আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি তার আনুগত্যও পরীক্ষিত। বাংলাদেশের মানুষ যদি প্রতিদিন এই কাগজের আয়নায় নিজেদের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক জীবনের সঠিক ছবিটি দেখতে পায় সেটাই হবে এই দৈনিকটির সাংবাদিকতার সার্থকতা। বাংলাদেশ এখন সংবাদপত্র প্লাবিত দেশ। ভালো-মন্দ কাগজের ভিড়ে অনেক সময় ভালো কাগজ চেনা যায় না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের বৈশিষ্ট্য, জন্ম থেকেই এ কাগজটি সবার চোখে পড়ছে এবং চোখে পড়ছে একটি ভালো কাগজ হিসেবে। তাই দিন দিন কাগজটির প্রচার বাড়ছে এবং প্রতিষ্ঠাও বাড়ছে। সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ দেশে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক এটা আমার কামনা।

লন্ডন, ১৩ মার্চ, সোমবার, ২০১৭

সর্বশেষ খবর