বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তোমরা সব কন্টাক্টে থাক ট্রেনিংয়ে যেতে হবে

আমির হোসেন আমু

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তোমরা সব কন্টাক্টে থাক ট্রেনিংয়ে যেতে হবে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগেই আমাদের বলেছিলেন, ৬ দফা নিয়ে আমরা কারও সঙ্গে আপস করব না। প্রয়োজনে আমরা অন্যদিকে যাব। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাই। ’৭১ সালের ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্বাচিত এমএনএ-এমপিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি জনসভা করলেন। সে জনসভায় পরিষ্কার ঘোষণা দিলেন ৬ দফা এখন আমার বা আওয়ামী লীগের একক দাবি নয়, ৬ দফা এখন সমগ্র জাতির দাবি। ৬ দফা সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচন করেছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার মধ্যে প্রমাণিত হয় ৬ দফা বাঙালির দাবি। নির্বাচনে ৬ দফা ম্যান্ডেট পেয়েছে। ৬ দফার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মুক্তির সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আমরা বিএম কলেজে ৩০০-৪০০ ছাত্র-জনতার সঙ্গে যোগাযোগ করি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমরা সব কন্টাক্টে থাক। তোমাদের যে কোনো মুহূর্তে ট্রেনিংয়ে যেতে হবে এবং যে কোনো ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কাজে নেমে পড়তে হবে। মার্চের আগে থেকেই আমরা গণসংগীতের আসর করতাম, জনসভা করতাম। এমনিভাবে আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেন, তখনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা স্লোগান দিল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা-আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। এখানে যদি যুদ্ধের প্রস্তুতি না থাকত, তাহলে আমাদের যুদ্ধে নেমে পড়া সম্ভব হতো না। বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১ মার্চ গোলমাল শুরু হয়, গোলাগুলি হয়। ৩ মার্চ ঘোষণা দিলেন, ৭ মার্চ বিস্তারিত বলবেন। এরপর ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। মাত্র সাড়ে ১৭ মিনিটের ভাষণে তিনি পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের দুঃশাসন-নিপীড়ন তুলে ধরলেন। একই সঙ্গে ১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো তুলে ধরলেন। একই সঙ্গে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে যা ঘটেছে সেগুলো তুলে ধরলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, আমার ভাইদের বুকে আর গুলি চালাবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন তোমরা সাত কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কথা ছিল এবং স্বাধীনতা কীভাবে ছিনিয়ে আনতে হবে সেসব দিকনির্দেশনা ছিল। তিনি বললেন, গ্রামে গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় থানায় থানায়, জেলায় জেলায় প্রত্যেক জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলো এবং তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং গেরিলা যুদ্ধের সার্বিক বিবরণ তার বক্তব্যের মধ্যে ছিল। সব মিলে ৭ মার্চের ভাষণ এক নতুন মাত্রা পায়। ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি এবং ক্যাম্প করি। ১ মার্চ থেকেই সারা দেশে বাঙালির মুখে মুখে স্বাধীনতার স্লোগান উচ্চারিত হয়। ২৫ মার্চে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যখনই পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় যেতেন ফিরে এসে তিনি কখনই আন্দোলন স্থগিত করেননি বা আন্দোলন স্থগিত করে আলোচনায় যাননি। বরং বলতেন আন্দোলন চলছে, আন্দোলন চলবে। কারণ তিনি জানতেন পাকিস্তান আমাদের দাবি মেনে নেবে না। ২৫ মার্চ সন্ধ্যারাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে আমাদের ফোনে জানানো হলো, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মিরা বেরিয়ে এসেছে, আক্রমণ হবে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। সে নির্দেশনা পেয়ে আমরা প্রস্তুতি শুরু করি। আমরা স্থানীয় থানা থেকে রাইফেল-বন্দুক সংগ্রহ করলাম। পুলিশ লাইনসে গিয়ে বক্তৃতা দিলাম। তখন পুলিশ-আনসার বাহিনী আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করল। রাত সাড়ে ১২টায় খবর পেলাম পিলখানা ও রাজারবাগের পুলিশ লাইনসে হামলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলে গোলাগুলি চলছে। ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ডিসেম্বরে আমরা পেলাম একটি স্বাধীন দেশ। অনুলিখিন : রফিকুল ইসলাম রনি

সর্বশেষ খবর