শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

আত্মঘাতী যুবকের দেহ ছিন্নভিন্ন

র‍্যাবের নির্মাণাধীন প্রধান কার্যালয়ে বিস্ফোরণ, আইএসের ‘দায় স্বীকার’

নিজস্ব প্রতিবেদক

আত্মঘাতী যুবকের দেহ ছিন্নভিন্ন

আত্মঘাতী বিস্ফোরণের স্থানে আলামত সংগ্রহে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার রাজধানীর আশকোনায় প্রস্তাবিত র‍্যাব সদর দফতরে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা হয়েছে। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে অজ্ঞাত এক যুবক নিহত হয়েছেন। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন দুজন র‍্যাব সদস্য ল্যান্স করপোরাল মিজানুর রহমান ও কনস্টেবল আরিফুর রহমান। গতকাল দুপুর ১টা ৫ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে। আহত র‍্যাব সদস্যদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হামলার খবর শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে যান পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, র‍্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ পুলিশ, র‍্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অন্যদিকে বিবিসি জানিয়েছে, আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট—আইএস। আইএসের মুখপত্র ‘আমাক’-এর বরাত দিয়ে বিবিসি বলেছে, আমাক মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে আইএস এই হামলার দায় তাদের বলে দাবি করেছে।

র?্যাবের পরিচালক (গণমাধ্যম) কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দুপুর ১টার দিকে আশকোনায় প্রস্তাবিত র?্যাব সদর দফতরের সীমানাপ্রাচীর টপকে এক যুবক ভিতরে প্রবেশ করে। অপরিচিত লোক দেখে তাকে চ্যালেঞ্জ করে র?্যাব। একপর্যায়ে যুবক প্রথমে পালানোর চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে তার শরীরের সঙ্গে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

আশকোনা হাজী ক্যাম্পের দেয়াল ঘেঁষে প্রস্তাবিত র‍্যাব সদর দফতরের অবস্থান। প্রধান ফটকের সামনেই র‍্যাবের লোগোসংবলিত একটি সাইনবোর্ডে ফোর্সেস ব্যারাক, র‍্যাব ফোর্সেস সদর দফতর লেখা। স্থাপনার চারপাশ ৯ ফুট উঁচু সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভিতরে এক পাশে চলছে নির্মাণাধীন সদর দফতরের কার্যক্রম, অন্য পাশে র‍্যাব সদস্যদের ব্যারাক। অন্য শুক্রবারের মতো গতকালও র‍্যাব সদস্যরা নামাজের জন্য গোসলখানায় গোসল ও অজু করছিলেন। ঠিক ১টা ৫ মিনিটে এক অজ্ঞাত যুবক হাজী ক্যাম্প লাগোয়া সীমানাপ্রাচীর টপকে ভিতরে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটায়। হামলার পরপর সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় অসংখ্য উত্সুক মানুষের ভিড়। র‍্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকা ঘিরে রেখেছেন। স্থাপনার সামনের রাস্তা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। সবারই প্রশ্ন— র‍্যাবের ওপর অ্যাটাক করল! র‍্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্মাণাধীন ওই স্থাপনার প্রবেশ ফটকে কমপক্ষে চারজন র‍্যাব সদস্য সারাক্ষণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন। ক্যাম্পের সীমানাপ্রাচীর টপকে হামলাকারী ভিতরে ঢুকে পড়লে দুজন নির্মাণশ্রমিক তার পরিচয় জানতে চান। সে নিজেকে র‍্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেয়। নির্মাণশ্রমিকরা গেটে দায়িত্বরত দুই র‍্যাব সদস্যকে ডাক দেন। দুই র‍্যাব সদস্য ওই যুবকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক ওই সময়ই ল্যান্স করপোরাল মিজান ও কনস্টেবল আরিফ ছুটে যান যুবকটির দিকে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই যুবক তার পরনের সুইসাইডাল ভেস্টের সুইচে চাপ দেয়। মুহূর্তেই ভেস্ট বিস্ফোরিত হয়ে ওই যুবক ঘটনাস্থলে মারা যায়। আহত হন র‍্যাব সদস্য মিজান ও আরিফ। মিজান র‍্যাব সদর দফতরের উপপরিচালক তানভীর আরাফাতের রানার আর আরিফ গাড়িচালক। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরিহিত যুবকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল একটি ব্যাক প্যাক। বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। ব্যারাকে উল্টো দিকের দাদা চা স্টলের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই! ১টা ৫ মিনিটের দিকে বিকট শব্দ কানে আসে। পুরা এলাকা কাঁইপ্যা ওঠে। কিছুই বুঝবার পারি নাই। পরে হুনি র‍্যাব ক্যাম্পের ভিতর এই ঘটনা। খুব ভয় লাগতাছে ভাই।’ প্রত্যক্ষদর্শী মোমেন তালুকদার বলেন, ‘জুমার নামাজ আদায় করতে হাজী ক্যাম্প মসজিদে যাচ্ছিলাম। এ সময়ই একটি বিকট আওয়াজ। প্রথমে মনে করছিলাম বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট হয়েছে। বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। সবাই ছোটাছুটি করতে থাকে। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় একজনের ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে।’

হামলার পরপরই ঘটনাস্থলে আসে র‍্যাব ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে একটি অবিস্ফোরিত শক্তিশালী বোমা, একটি ব্যাক প্যাক। তবে ওই ব্যাগের ভিতর কিছুই পায়নি তারা। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ওই বোমাটি নিষ্ক্রিয় করে নিষ্ক্রিয়করণ দল।

ক্যাম্পের ফটক থেকে দেখা যায়, ৫০ গজ দূরে ব্যারাকের সামনে একটি খোলা জায়গা হলুদ ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ঘটনার কিছুক্ষণ পর ২টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সকে ওই ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়।

এ হামলা কারা চালিয়ে থাকতে পারে— জানতে চাইলে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এ বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে যেভাবে হামলা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায় যে সে (হামলাকারী) জঙ্গিগোষ্ঠীর।

গত বছর জুলাইয়ে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে বেশ কিছু দিন পরিস্থিতি শান্ত থাকে। এরপর ৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার পর ধরা পড়ে দুই জঙ্গি। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতেই মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বুধবার বিকালে সীতাকুণ্ডের এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাশের ওয়ার্ডে আরেক বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট। আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সীতাকুণ্ড অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। নিহত নারী জঙ্গির পাশে বোমায় বিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর