রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

র‍্যাবের তল্লাশি চৌকিতে জঙ্গি নিহত

শরীরে বাঁধা বিস্ফোরক, আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা ছিল : র‍্যাব । সারা দেশে কঠোর নজরদারি

নিজস্ব প্রতিবেদক

র‍্যাবের তল্লাশি চৌকিতে জঙ্গি নিহত

খিলগাঁওয়ে তল্লাশি চৌকিতে গতকাল গুলিতে নিহত জঙ্গি —রোহেত রাজীব

রাজধানীর আশকোনায় হামলা চালানোর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের চেকপোস্টে হামলার চেষ্টা হয়েছে। তবে র‌্যাব সদস্যদের গুলিতে ওই হামলা চেষ্টাকারী অজ্ঞাত যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন র‌্যাবের দুই সদস্যও। র‌্যাবের ধারণা, নিহত যুবক একজন আত্মঘাতী জঙ্গি।

গতকাল ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ‘শেখের জায়গা’ মোড়ের কাছে তল্লাশি চৌকিতে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে যান র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ও সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা। তারা নিহত যুবকের কোমরে এবং পিঠে থাকা ব্যাগ থেকে উদ্ধারকৃত দুটি বোমা নিষ্ক্রিয় করেন। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান, শুক্রবার রাজধানীর আশকোনায় আত্মঘাতী হামলার পর দেশের সব থানা, কারাগার, বিমানবন্দরসহ সব ধরনের বন্দরে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যেই গতকাল আবার এ ঘটনা ঘটল।

ঘটনা সম্পর্কে র‌্যাবের ভাষ্য : ভোরে শেখের জায়গা এলাকার চেকপোস্টে এক মোটরসাইকেল আরোহীকে থামার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তা অমান্য করে তিনি মোটরসাইকেলটি র‌্যাব সদস্যদের ওপর তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা আরোহীকে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান ২০-২৫ বছর বয়সী ওই যুবক। পরে নিহত যুবকের কাছ থেকে পাওয়া হাতে বানানো দুটি গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল। ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে দেড়শ মিটার উত্তরে ফাঁকা জায়গায় বালুভর্তি বস্তা দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বোমাগুলো নষ্ট করা হয়। র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, হামলাকারীর দেহে একটি বেল্টে বিস্ফোরক বাঁধা ছিল। এক দিন আগে আশকোনায় হামলাকারীর দেহেও বিস্ফোরক বাঁধা ছিল। গতকাল ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে মোটরসাইকেল আরোহী ওই ব্যক্তি খিলগাঁওয়ের চেকপোস্টে তল্লাশির জন্য সিগন্যাল দেয়। তবে তিনি র‌্যাবের বাধা অমান্য করে উল্টো র‌্যাব সদস্যদের ওপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বাহিনীর সদস্যরা ওই যুবককে লক্ষ্য করে গুলি চালান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়কের সঙ্গে খিলগাঁও নন্দীপাড়া থেকে আসা সড়কটি ‘শেখের জায়গা’য় এসে মিলেছে। ঘটনাস্থলের কয়েকশ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা নেই। তবে লিংক রোডের মাথায় কয়েকটি চায়ের দোকান রয়েছে। মোড় থেকে কয়েকশ মিটার দক্ষিণে র‌্যাবের অস্থায়ী তল্লাশি চৌকি। ওই যুবক মোড় থেকে মোটরসাইকেলে খিলগাঁওয়ের দিকে যাচ্ছিলেন বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

সকালে সরেজমিন দেখা যায় ঘটনাস্থলের আশপাশে ধান খেত ও খালি জায়গা। আশপাশে তেমন একটা জনবসতি নেই। র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছেন। নিহত যুবকের নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। পরনে ছিল শার্ট ও জিনসের প্যান্ট। নিহতের মাথা সড়কের দিকে এবং পা জমিতে ছিল। মাথার পাশেই ছিল ব্যাগটি। পড়ে ছিল মোটরসাইকেলটি। টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলটির কোনো নম্বর প্লেট ছিল না। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের এএসপি আবদুস সালাম জানান, তারা নিহত যুবকের শরীরে ছয় থেকে সাতটি গুলির চিহ্ন দেখেছেন। লাশ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছেন। বোমা নিষ্ক্রিয় করার জায়গা থেকেও নমুনা নেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলের কয়েকশ গজ দূরের এক দোকানদার বলেন, ‘ভাই! ঘুমে ছিলাম। তবে আমি গোলাগুলির কোনো আওয়াজ পাইনি। ঘটনার কিছু সময় পর শোরগোল শুনে ঘুম ভাঙে। তখন থেকে সড়কটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্ধ করে দেয়।’

ময়নাতদন্ত সম্পন্ন : গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে একটি পিকআপে নিহত ওই যুবকের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায় খিলগাঁও থানা পুলিশ। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা।

পরে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, ‘৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ওই যুবক মারা গেছেন। যুবকের শরীরে আমরা চারটি গুলির চিহ্ন পেয়েছি। এর মধ্যে তিনটি তার বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়েছে। আরেকটি ডান পায়ের সামনে দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়েছে।’ তিনি আরও জানান, ‘নিহত যুবকের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য তার চুল এবং ডিএনএ টেস্টের জন্য থাই মাসল সংগ্রহ করা হয়েছে। হামলার আগে তিনি শক্তিবর্ধক কিছু খেয়েছিলেন কিনা, তা নিরূপণের জন্য রক্ত ও ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। এরপর তা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’ প্রসঙ্গত, সম্প্রতি গাজীপুরের টঙ্গীতে জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুুল হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে প্রিজন ভ্যানে বোমা হামলা হয়। এরপর গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করে পুলিশ। তারপর সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে চারজন নিহত হন। তাদের মধ্যে অন্তত দুজন আত্মঘাতী ছিলেন। এ সময় গ্রেফতার হন এক দম্পতি। শুক্রবার আশকোনায় ‘আত্মঘাতী হামলা’র ঘটনাটি আইএস ঘটিয়েছে বলে আইএসের মুখপত্র ‘আমাক’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়। তবে হামলায় আইএসের সম্পৃক্ততার খবর বরাবরের মতোই নাকচ করেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সারা দেশে কঠোর নজরদারি চেকপোস্টে তল্লাশি : রাজধানীতে পরপর দুটি জঙ্গি হামলা ও সীতাকুণ্ডে আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর সারা দেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কঠোর নজরদারি চলছে সর্বত্র। রাস্তায় রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। চেকপোস্টে সদাসতর্ক পুলিশ ও র‌্যাব। কূটনৈতিক পল্লী গুলশান-বনানীতে পুলিশি তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতিমধ্যে বিমানবন্দর, নৌবন্দর, কারাগারসহ স্পর্শকাতর সব স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, বেতার ভবন, কমলাপুর  রেলস্টেশন, সচিবালয় এলাকা, কূটনৈতিক এলাকা, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, বিদ্যুেকন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বাস, লঞ্চ টার্মিনাল ও ভিআইপি এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে দেশের প্রতিটি জেলায়। রাজধানীতে পরপর দুটি হামলার ঘটনার পর গুলশান-বনানী এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হচ্ছে। ‘ডিপ্লোম্যাটিক জোন’ বলে পরিচিত এ দুটি এলাকার হোটেল- রেস্টুরেন্টগুলোর দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজর বাড়িয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গতকাল গুলশান এলাকার বেশ কয়েকটি হোটেল-রেস্টুরেন্টে গিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পুলিশ। এ সময় হোটেলগুলোর পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা, হোটেলে প্রবেশ পথ, হোটেলের অবস্থান এবং হোটেলে কারা কারা অবস্থান করেন, তার তথ্য সংগ্রহ করে। পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, আশকোনায় র‌্যাবের ক্যাম্পের সামনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পর তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় যাচ্ছেন। আর এতে গুলশান-বনানী এলাকার হোটেলগুলোর ওপর নজরদারি ও পুলিশি নিরাপত্তার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য  দেওয়া হচ্ছে। আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্পে জঙ্গি হামলার ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর বনানী ১১ নম্বর সড়কের বেশ কয়েকটি ক্যাফেতে গিয়ে পুলিশ আর্চওয়ে ও বিমানবন্দরের মতো চেকিং যন্ত্রপাতি লাগাতে নির্দেশ দিয়ে আসে।

গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, গুলশান-বনানীতে এখন পুলিশের চেকপোস্টগুলোতে কড়া তল্লাশি চলবে। তৎপরতা বাড়বে পুলিশের। তবে নতুন করে কোথাও চেকপোস্ট বসানো হবে না।

বরিশাল : বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের পর সারা দেশের মতো বরিশালেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকাসহ মুন্সীগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে : নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া জানান, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বিপিএম, পিপিএম বলেছেন, ‘দেশে আইএসসের অস্তিত্ব নেই। আইএসের কার্যক্রম যেন দেশে না হয় এজন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। অন্যান্য দেশের ইন্টারপোল কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। তাই কোনো জঙ্গি বা দুষ্কৃতিকারী দেশ ত্যাগ করতে পারবে না। জঙ্গি নির্মূলে দেশের সব পেশাজীবী, সুশীলসমাজ, মসজিদ-মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

জঙ্গি নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান চলমান আছে।’

গতকাল বিকালে বগুড়া পুলিশ লাইনস মাঠে জেলা পুলিশের বার্ষিক সমাবেশ ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের পুরস্কার বিতরণকালে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন।

সর্বশেষ খবর