শিরোনাম
সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
আগুনঝরা মার্চ

ব্রিজ পুড়িয়ে পাকিস্তানি আর্মি ঠেকালাম

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন

ব্রিজ পুড়িয়ে পাকিস্তানি আর্মি ঠেকালাম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন ইয়াহিয়া খানের অধীন, এলএফের অধীন নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তিনি ক্ষমতা পাবেন না। তারপরও তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ১৯৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও ভাসানী ন্যাপসহ অন্যান্য দল এই নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল। তারা বলেছিল, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। বঙ্গবন্ধু জানতেন এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও তিনি ক্ষমতা পাবেন না। কিন্তু উনি চেয়েছিলেন পর্বত প্রমাণ যে বৈষম্য, আমাদের অর্থ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেখানে যে উন্নয়ন করছে সেই বৈষম্য দূর করার জন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা খুবই জরুরি। সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনই পেয়েছিলাম আমরা। আমরা মেজরিটি হলাম। মেজরিটি পার্টির নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিয়ম অনুযায়ী তাকে সরকার গঠনের জন্য ডাকার কথা। কিন্তু তা না করে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অ্যাসেম্বলি ডাকলেন। ভুট্টো হুমকি দিয়ে বললেন, ওই দিন অ্যাসেম্বলি কসাইখানায় পরিণত হবে। এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করলেন। তার এ বক্তব্যের জের ধরে সারা বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। দেশজুড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল শুরু হলো। এরপর ৭ মার্চ এলো। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু একজন মহাকবির মতো সেদিন বাঙালির মুক্তির জন্য ভাষণ দিলেন লাখ লাখ মানুষের সামনে। সেদিন তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এমনভাবে ভাষণ দিলেন, যাতে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীও হলেন না, আবার স্বাধীনতারও ডাক দিলেন। এতে করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিতে পারল না। সেদিনের ঐতিহাসিক বক্তব্যে তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি সংগ্রাম চালিয়ে যাও, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো।’ তিনি সেনাবাহিনীকে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও।’ তার এই ১৯ মিনিটের বক্তব্যের পর সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ১৭ মার্চ আরেকটি ঘটনা। তরুণ এমপি, তরুণ নেতা হিসেবে আমি যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমি চিন্তা করলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ওই দিনই আমি চট্টগ্রামের একজন নেতা দোহাসকে নিয়ে ৩২ নম্বরে গেলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা  করতে। তিনি দেখেই বললেন, কিরে দোহাস তোরা চট্টগ্রাম থেকে কেন এসেছিস? তখন দোহাস বললেন, মোশাররফ আপনাকে কী বলবে। তখন বঙ্গবন্ধু উঠে গিয়ে বললেন, কী কথা? তখন আমি বললাম মাননীয় বঙ্গবন্ধু, আমি কিছু এক্সক্লোসিভ সংগ্রহ করতে চাই এবং এক্সক্লোসিভ দিয়ে শুভপুর ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে চাই। এটি হচ্ছে মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র লিংক। শুনেই বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, শাবাশ। তুই এক্সক্লোসিভ জোগাড় করে অর্ধেক চট্টগ্রামে নিয়ে যাবি আর অর্ধেক ৩২ নম্বরে রেখে যাবি। আমি এক্সক্লোসিভ জোগাড় করতে ছাতক পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০ মার্চ পর্যন্ত এক্সক্লোসিভ জোগাড় করতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে গেলাম চট্টগ্রামে। কারণ এক্সক্লোসিভ জোগাড় করতে পারলেও ডেটেনেটর সংগ্রহ করতে না পারায় হতাশ হয়ে যাই। ডেটেনেটর ছাড়া কাজ হবে না। চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে জানতে পারলাম সোয়াত স্টিমারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র নিয়ে এসেছে। এই অস্ত্র নামিয়ে তারা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে। এ কথা জানার পর আমরা বিশাল সমাবেশ করে লাটিসোঁটা, রড নিয়ে এসে ২১ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দর ঘেরাও করি এবং বলতে থাকি অস্ত্র নামানো যাবে না। আমরা চলে আসার পর সেদিন সন্ধ্যায়ই গোলাগুলির খবর পেলাম। পরে শুনলাম সেখানে বেশ কিছু বাঙালি অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ২৩ মার্চ ঝাউতলার দিকে যেখানে বিহারিরা থাকত সেখানেও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ২৫ মার্চ বিকালে আমার কাছে খবর এলো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টকে শক্তিশালী করতে ২৬ ট্রাক আর্মি কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হচ্ছে। কারণ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি আর্মি শক্তিশালী ছিল না। এখানে বাঙালি অফিসার বেশি ছিল। খবর পেয়ে আমি লোকজন নিয়ে আমার নিজের এলাকা মিরসরাই যাই। আমি আমার ফক্সওয়াগন ২৯৬ গাড়ি নিজে চালিয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার দিকে সেখানে যাই। সেখানে পৌঁছে আমি আমার লোকজন দিয়ে শুভপুর ব্রিজের একটি অংশ যেটি কাঠের তৈরি ছিল সেটি বিটুমিন, কেরোসিন, ডিজেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিই। এতে চট্টগ্রাম প্রবেশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনা ঘটিয়ে চট্টগ্রাম শহরে ফেরার পর দেখতে পেলাম পুরো শহর লোকেলোকারণ্য। আমি সবাইকে বললাম, যার যা কিছু আছে সব নিয়ে আসো। ২৬ ট্রাক পাকিস্তান আর্মি আসতেছে এদের প্রতিরোধ করতে হবে। রাস্তা বন্ধ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি কর। লোকজন গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। রাত ১২টায় আমি যখন শহরের রেল স্টেশনে পৌঁছলাম তখন স্টেশন মাস্টার আমাকে ইশারা দিয়ে দাঁড় করাল এবং বলল, বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন পাক সেনা এদেশে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত। ভোর রাত ৪টার দিকে যখন ফৌজদারহাট পৌঁছলাম তখন সেখানে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা অনেক বাঙালি অফিসার-জওয়ান দেখলাম। তারা আমাকে জানাল, ক্যান্টনমেন্টে ঘুমন্ত বাঙালি অফিসারদের ওপর পাকিস্তান আর্মি হামলা চালিয়েছে। অনেককে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মি যাকে যেখানে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে। আমি আমাদের এমপি ইসহাক সাহেবের আগ্রাবাদের বাসায় গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম অনেক ইপিআর সদস্য আর্মস নিয়ে এসেছে। তারাও জানাল, তাদের অনেক সদস্য মারা গেছে। ইসহাক সাহেব তাদের আশ্রয় দিলেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। সেখান থেকে আমি সকাল ৭টার দিকে বাসায় গেলাম। দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে বেলা ১১টায় আবার বের হয়ে আন্দরকিল্লায় পার্টি অফিসে গেলাম। সেখানে ছিল পার্টির সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার (এমএনএ), ছাত্রলীগ নেতা রাখাল চন্দ্র বণিক ও শাহজাহান চৌধুরী। আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট আকারে মানুষের মধ্যে বিতরণ করি এবং অফিস পিয়ন নূরুল হককে দিয়ে মাইকে করে প্রচার চালালাম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। আমাদের কাছে বন্দুক ছিল। ২৬ মার্চ দুপুর ১টার দিকে আমরা একটা জিপে করে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে গেলাম। ইপিআরের কিছু সদস্য সেটি পাহারা দিচ্ছে। এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি আগেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিল সেটি সুন্দর করে লিখে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দিলাম। এ সময়টায় চট্টগ্রাম মুক্ত ছিল। এই সময়টায় অর্থাৎ ২৫ মার্চ মধ্য রাতে মেজর জিয়াউর রহমান প্রায় ৩০০ সৈনিক নিয়ে কোনো রকম প্রতিরোধ না করেই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে বোয়ালখালী কড়াইলডাঙ্গা পাহাড়ে অবস্থান নেন। অথচ জিয়া যদি তার ৩০০ সৈনিক এবং ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতেন তাহলে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট আমাদের দখলে চলে আসত। সেটা না করে তিনি পালিয়ে গেছেন। ২৬ মার্চ এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন এবং ওই দিন সন্ধ্যায় আতাউর রহমান খান কায়সার গিয়ে জিয়াকে জানালেন চট্টগ্রাম মুক্ত আছে। ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে জিয়া তার সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে এসে কালুরঘাট ব্রিজ ও বেতারকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ না করে বেতারে একটা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রাখলেন। আমাদের একটা কন্ট্রোল রুম ছিল। ২৬ মার্চ রাতে সেটি ছিল আখতারুজ্জামান বাবুর বাসায়। ২৭ তারিখ রাতে সেটি ছিল আমার বাসায়। সেখানে এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ হান্নান আমরা বৈঠক করলাম। ২৮ মার্চও দুপুরে জিয়া একইভাবে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য রাখলেন। এটা শুনে এম আর সিদ্দিকী বললেন, ওর কাছে যান এবং বলেন এটি বন্ধ করতে। আমরা গিয়ে তাকে এসব বিভ্রান্তিকর বক্তব্য থামানোর কথা বললাম। তিনি ভুল স্বীকার করলেন। আমরা লিখিত ভাষণ দিলাম। এম আর সিদ্দিকীর ড্রাফট করা ভাষণ জিয়া আমার এবং মির্জা মনসুরের সামনে ২৯ মার্চ সকালে বেতারে বললেন, ‘আই অন বিহ্যাফ অব গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার দি ইন্ডিপেন্ডেন্টস অব বাংলাদেশ। অ্যান্ড হি অর্ডার টু কন্টিনিউর দি ওয়ার।’ রেকর্ড করা এ বক্তব্যই কন্টিনিউ বেতারে বাজতে থাকল।

লেখক : আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী

অনুলিখন : নিজামুল হক বিপুল

 

সর্বশেষ খবর