মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
আগুনঝরা মার্চ

সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ১৯ মার্চ

আ ক ম মোজাম্মেল হক

সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ  ১৯ মার্চ

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিল গাজীপুরের (সেই সময়ের জয়দেবপুর) বীর জনতা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে লাঠি-ছেনি ও গাদা বন্দুক নিয়ে গর্জে উঠেছিল জয়দেবপুরের জনগণ। একপর্যায়ে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তিনজন বীর বাঙালি। আহত হয়েছিলেন শত শত স্বাধীনতাপ্রিয় জনতা। জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে অবস্থানরত ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হচ্ছে-এমন সংবাদ পেয়ে হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক জনতা সেদিন জয়দেবপুরের রেলপথ ও রাজপথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। কোথাও রেললাইন তুলে ফেলে, রেলগেটে মালগাড়ির বগিসহ অকেজো রেললাইনের স্লিপার ও বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। যাতে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় ফেরত যেতে না পারে। তখন জয়দেবপুরে নিয়োজিত ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি হন। আমরা যখন ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম তখন টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি কনভয় জয়দেবপুর আসছিল। জনতা রেশনের গাড়িটি আটকে দেয় এবং কনভয়ে থাকা ৫ জন সৈন্যের চাইনিজ রাইফেল ও গুলি কেড়ে নেয়। এদিকে রেলগেটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য ২য় ইস্টবেঙ্গলের রেজিমেন্টকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব আদেশ দেন। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে ঠেলে দিয়ে পেছনে রাখা হয় পাঞ্জাবি সৈন্যদের। একপর্যায়ে মেজর সফিউল্লাহকে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেওয়া হয়।

 কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা বাঙালি জনতার ওপর গুলিবর্ষণ না করে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সামনে এগোতে তাকে। আমরা বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে পেছনে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করি। এ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে প্রথম শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা। আহত হন সন্তোষ, ডা. ইউসুফসহ কয়েকশ মানুষ। পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ  শুরু করলে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। এরপর ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে সড়ক পথের ব্যারিকেড পরিষ্কার করতে করতে চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার জনতার প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এখানে নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত আলী এক পাঞ্জাবি সৈন্যকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করে তার অস্ত্র কেড়ে নেন। আমরাও সৈন্যদের রাইফেল কেড়ে নিই। কিন্তু পেছনের এক পাঞ্জাবি সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করে। হুরমত সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন।  বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। ১৯ মার্চের জয়দেবপুরের জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর দ্রুত দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সারা  দেশে স্লোগান উঠে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর-সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর’।

মনে পড়ে মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। জয়দেবপুরে আমার পরামর্শে ২ মার্চ রাতে তৎকালীন থানা পশু পালন কর্মকর্তা আহম্মেদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব উল্লাহ এক সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেন। সভায় আমাকে (আ ক ম মোজাম্মেল হক) আহ্বায়ক করে এবং মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খানকে (বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ৩ মার্চ জয়দেবপুরে এই সর্বদলীয় পরিষদের উদ্যোগে গাজীপুর স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের বটতলায় এক সমাবেশ করে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৭ মার্চ জয়দেবপুর থেকে হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে করে এবং শতাধিক ট্রাক ও বাসে করে মাথায় লাল ফিতা বেঁধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা ১১ মার্চ গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা (অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি) আক্রমণ করি। এ সময় কারখানার বন্ধ গেটের সামনে টেবিলে দাঁড়িয়ে আমি মাইকে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহকে কারখানার পরিচালক পদ থেকে বরখাস্তের ঘোষণা দিই। এদিকে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বক্তৃতা চলাকালীনই পেছনের গেট দিয়ে সালনা হয়ে পালিয়ে ঢাকা চলে যান। জনতার প্রতিরোধের মুখে ১৩ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান জয়দেবপুর রাজবাড়ী মাঠে হেলিকপ্টার  অবতরণ করতে না পেরে ঢাকা ফিরে যান।

১৭ মার্চ ছিল মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। জনতার ঢল নেমেছিল সেদিন ৩২ নম্বরে। সেদিন আমাদের নির্বাচনী এলাকার এম এল এ সামসুল হক (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য), হাবিব উল্লাহসহ আমিও গিয়েছিলাম। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে জয়দেবপুরে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার সংবাদ দিই। জানাই, কুর্মিটোলা (ঢাকা) ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্রের মজুদ কমে গেছে অজুহাতে জয়দেবপুরে রক্ষিত অস্ত্র ঢাকায় আনার পরিকল্পনার কথা। শুনে তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। সামসুল হক সাহেবের ইশারায় আমি তরুণ হিসেবে এ অবস্থায় আমাদের কী করণীয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু ব্যাঘ্রের ন্যায় গর্জে উঠে বললেন, ‘তুই একটা আহাম্মক, কী শিখেছিস যে আমাকে বলে দিতে হবে’। একটু পায়চারি করে বললেন ‘বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে দেওয়া যাবে না। ‘Resist at the cost of anything’ নেতার হুকুম পেয়ে গেলাম।

১৯ মার্চ শুক্রবার জয়দেবপুর হাইস্কুলের মুসলিম হোস্টেলের পুকুরে গোসল করার সময় আকস্মিক খবর পাই, বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে অস্ত্র নিয়ে যেতে ঢাকা থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব এসেছেন। আমি দ্রুত গিয়ে  হাবিব উল্লাহ ও শহীদ উল্লাহ বাচ্চুকে এ সংবাদ জানাই। শহীদ উল্লাহ বাচ্চু তখনই রিকশায় চড়ে শিমুলতলীতে, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্লান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানায় শ্রমিকদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসার খবর দেন। এক ঘণ্টার মধ্যে মাঠেই হাজার হাজার শ্রমিক-জনতা চারদিক থেকে লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা, ছেনি, দোনালা বন্দুকসহ জয়দেবপুর উপস্থিত হয়। সেদিন জয়দেবপুর হাটের দিন ছিল। সব মানুষ হাতে হাত লাগিয়ে রেলপথ ও সড়ক পথে ব্যারিকেড দেওয়া শুরু করল। এভাবেই ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। তাই জাতীয়ভাবে এই দিবসটি পালিত হলে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ মূল্যায়ন হবে বলে মনে করি। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর