বুধবার, ২২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
মাগুরায় বিশাল জনসভায় শেখ হাসিনা

উন্নয়নের স্বার্থে আওয়ামী লীগে শামিল হোন

রাশেদ খান, মাগুরা

উন্নয়নের স্বার্থে আওয়ামী লীগে শামিল হোন

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভোট চুরির অপরাধে জনগণ যাদের (বিএনপি-জামায়াত জোট) ক্ষমতা থেকে হটিয়েছে তারা আবারও ক্ষমতায় এলে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। কারণ তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তাই উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বার্থে সবাই আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হোন, আওয়ামী লীগের হাত শক্তিশালী করুন। ২০১৯ সালের নির্বাচনেও নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ দেবেন। আমাদের লক্ষ্য উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ গতকাল বিকালে মাগুরায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ করা। আপনারা বার বার নৌকায় ভোট দিয়েছেন। নৌকায় ভোট দিয়েছেন বলেই আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আপনারা উন্নয়নের মুখ দেখছেন। তাই আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দেশসেবার সুযোগ দিন। আমরা দেশের আরও দ্রুত উন্নয়ন করব, দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শান্তিময়, কল্যাণকর ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব।’ বিশাল এ জনসভায় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতার শুরুতেই ক্রিকেট বিশ্বের বিস্ময় মাগুরার কৃতী সন্তান সাকিব আল হাসানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আপনাদের এই মাটির ছেলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় এনে দিয়েছে। সে ব্যাটে-বলে পারফরম্যান্স করেছে। আমরা জয় পেয়েছি।’ এই ঐতিহাসিক জয়ের জন্য সব খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তাকে অভিনন্দন জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের মাটি ও মানুষের সংগঠন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এ দেশকে স্বাধীন করেছিলেন বলেই দেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হয়, তা আমরা প্রমাণ করেছি।’ আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘পিতা-মাতা, ভাইসহ সবাইকে হারানোর দুঃসহ দুঃখ-যন্ত্রণা বুকে নিয়েই দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত-সমৃদ্ধ করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’ গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গ্যাস ভারতের কাছে বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় এসেই আমাদের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন, সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেন।’ তিনি বলেন, ‘বার বার আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমি আর কারও কাছে মাথা নত করি না, কাউকে ভয় পাই না।’

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি তানজেল হোসেন খানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ কুণ্ডুর পরিচালনায় জনসভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষকান্তি ভট্টাচার্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, স্থানীয় এমপি মেজর জেনারেল আবদুল ওয়াহাব (অব.), কেন্দ্রীয় নেতা এস এম কামাল হোসেন, পারভীন জাহান কল্পনা, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব সাইফুজ্জামান শিখর, মহিলা আওয়ামী লীগের সাফিয়া খাতুন, যুব মহিলা লীগের নাজমা আখতার ও অপু উকিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নির্মল রঞ্জন গুহ, যুবলীগের আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগের এস এম জাকির হোসেন, স্থানীয় নেতা এ এফ এম আবদুল ফাত্তাহ, মুন্সী রেজাউল হক, আবু নাসির বাবলু, সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, শফিকুজ্জামান বাচ্চু, রুস্তম আলী, হাজী গোলাম মাওলা প্রমুখ।

বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকতে শুধু মাগুরাই নয়, গোটা বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল তারা। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ উপনির্বাচনে মাগুরাবাসীর ভোট চুরি করে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এর বিরুদ্ধে আমরা তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলি। আর সেই গণআন্দোলনেই ভোট চুরির অপরাধে খালেদা জিয়া ক্ষমতা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।’ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসীর স্থান হবে না। আমি দেশবাসীর কাছে অনুরোধ জানাব— নিজেদের সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখবেন। তারা যাতে কোনোভাবেই জঙ্গি-সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তে জড়িয়ে পড়তে না পারে।’ জঙ্গি-সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে আসতে চাইলে তাদের পুনর্বাসন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ এ পথ থেকে ফিরে স্বাভাবিক জীবনে আসতে চাইলে তাকে পুনর্বাসনসহ সরকার থেকে যা যা করার সবই করা হবে।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কোনো যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের গণহত্যাকারী, যারা দেশের মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের স্থান বাংলার মাটিতে হবে না। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। মাত্র এক দিনে আমরা নিঃস্ব-রিক্ত ও এতিম হয়ে গেছি। আমার বাবা-মা, ভাইসহ পরিবারের ১৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আমার পিতা বঙ্গবন্ধু এই দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশের মানুষের কল্যাণে আমিও যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। প্রয়োজন হলে বাবার মতোই আমার বুকের রক্ত দিয়ে দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব ইনশা আল্লাহ।’ হেলিকপ্টারযোগে প্রধানমন্ত্রী মাগুরা এসে সার্কিট হাউসে নামাজ আদায় ও মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে জনসভাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রায় ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৯টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশাল এ জনসভায় মাগুরার মাটি ও মানুষের নেতা প্রয়াত আছাদুজ্জামানের পুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর মাগুরাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি রেললাইন, মেডিকেল কলেজ এবং আইনজীবী সমিতি ও প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় মাগুরায় রেললাইন, আইনজীবী সমিতি ও প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে জনসভায় উপস্থিত লাখো মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়েন এবং গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। খুলনা বিভাগের প্রথম এই নির্বাচনী জনসভায় পুরো বিভাগে সাড়া পড়ে। লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে সমাবেশস্থল। মাগুরা স্টেডিয়াম ছাপিয়ে চারদিকে প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার এলাকার দীর্ঘ পথই ছিল জনতরঙ্গ। লাখো মানুষের গগনবিদারী স্লোগান ছিল— ‘শেখ হাসিনার সরকার বার বার দরকার’। স্টেডিয়াম ছাপিয়ে জনসভায় আসা মানুষের স্রোত ভায়নার মোড়, ঢাকা রোড, চৌরঙ্গির মোড়, নতুন মাজার, ইসাখাদা বাজার, কাটাখালী বাজার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অজস্র মিছিলের প্রতিটিতেই ছিল বিশাল বিশাল নৌকার প্রতিকৃতি ও আসল নৌকা। ঠেলাগাড়িতে বিশাল বিশাল নৌকা তুলে তার ওপর বৈঠা নিয়ে নৌকার মাঝির নৌকা চালানোর অসংখ্য দৃশ্যও প্রত্যক্ষ করেছেন মাগুরাবাসী। বেলা আড়াইটায় জনসভার জন্য নির্ধারিত সময়সূচি দেওয়া থাকলেও সকাল ১০টায়ই আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত অসংখ্য মিছিল আসতে শুরু করে সার্কিট হাউস ময়দান অভিমুখে। বিশাল এই মাঠটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসার আগেই কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে জনসভার ব্যতিক্রমী বিষয় ছিল পুরো স্টেডিয়ামসহ আশপাশ এলাকায় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের জন্য প্রায় ২৫ হাজার লিটার পানি, ২৫ মণ চিঁড়া, ৫ মণ বাতাসাসহ নানা শুকনো খাবারের ব্যবস্থা। এ ছাড়া জনসভায় আসা নারী নেতা-কর্মীদের জন্য আশপাশের বাড়িতে বিশ্রাম ও টয়লেট ব্যবহারের সুযোগও রাখা হয়।

সর্বশেষ খবর