বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বড় প্রকল্প ছাড়া কাজে গতি নেই প্রশাসনে

সুবিধাবাদীরা গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের

নিজামুল হক বিপুল

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোতে কাজকর্মে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এসে অনেকটাই গতিহীন হয়ে পড়েছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র। ঢিলেঢালাভাবে চলছে সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজকর্ম। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। প্রশাসন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রশাসনের কাজে-কর্মে ততই ভাটা পড়ছে।  ফলে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের কাজেও গতি কমে গেছে। মোটা দাগে অগ্রাধিকার প্রকল্প ছাড়া সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কাজের প্রকল্পগুলো গতি পাচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। একাধিক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সরকারের দুই মেয়াদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ কয়েক দফায় নিজেদের পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। সর্বশেষ গত বছর হওয়া পদোন্নতির পর থেকে কর্মকর্তারা এখন গা ছাড়া ভাব নিয়ে কাজ করছেন। অন্যদিকে দফায় দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা শুধু পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের তামাশা দেখছেন। আমলাদের এমন গা ছাড়া ভাবের কারণে সরকারের যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল সেগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অনেক মন্ত্রণালয় ও দফতরে সরকারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুধু কর্মকর্তাদের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। প্রশাসন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার এখন নির্বাচনমুখী। তাই প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজে ঢিল দিয়েছেন। নির্বাচন সামনে রেখে তারা হাওয়া বোঝার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে? সরকারে কারা আসবে? সেই বিষয়গুলোই এখন পর্যবেক্ষণ করছেন বেশির ভাগ কর্মকর্তা। বলতে গেলে এসব কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে এসে নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যেসব কাজ মন্ত্রণালয় বা দফতরেই করা সম্ভব, সেগুলো ওপরমহলের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন তারা। প্রশাসন ক্যাডারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি উদাহরণ হচ্ছে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। তার চাকরি থাকবে কি থাকবে না, তা ছিল নিতান্তই পুলিশ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু সেটি না করে, সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত যেতে হয়েছে। অর্থাৎ কেউই দায়দায়িত্ব নিচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো ছাড়া আর কোনো প্রকল্পেই উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল লাইন-৬, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দরের মতো এমন মোটা দাগের কয়েকটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজই হচ্ছে। অন্য কাজের কোনো খবর নেই। সরকার রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত এবং ঢাকার ট্রান্সপোর্ট সুবিধা বাড়াতে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) গ্রহণ করলেও সেটি বাস্তবায়নে যেসব প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগের কাজই এখন পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। এ রকম আরও অনেক প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো শুরুই করা যায়নি। সরকার কাজের গতি বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগ করলেও কাজের গতি বাড়েনি। উপরন্তু বিভক্ত হওয়ার পর এসব মন্ত্রণালয়ে জটিলতা আরও বেড়েছে। জনবল এবং অফিসকক্ষ সংকটসহ নানামুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের সংস্কারের বিষয় নিয়েও প্রশাসন ক্যাডারের একটা বড় অংশের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এটিও কাজে স্থবিরতার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ। ২০১১-১২ সালে প্রশাসনে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কর্মকর্তাদের এসিআরের পরিবর্তে বার্ষিক পারফরমেন্স রিপোর্ট (এপিআর) চালু করার বিষয়টি, যার মাধ্যমে প্রশাসনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিজীবনের মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ করে এপিআর ম্যূলায়নের ভিত্তিতে যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের একটা অংশের কারণে এই এপিআর পদ্ধতি আর চালুই করা যায়নি। গত প্রায় পাঁচ বছরেও এই সংস্কার উদ্যোগ আর আগায়নি। এখন সেটিতে ধুলোর স্তূপ পড়ে গেছে। এই সংস্কার না হওয়ার কারণে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ, যারা কিনা দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী, তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আছে। আবার যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করে পদোন্নতি আদায় করে নিয়েছেন, অনেকেই ভালো কর্মস্থলে পদায়ন না পাওয়ায় তাদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ আছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাজের গতি কমে গেছে বা ভাটা পড়েছে সেটা ঠিক নয়। আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে যেভাবে কাজের সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছি সেভাবেই সেই সময়ের মধ্যে কাজ হচ্ছে। সব কাজই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, কাজের সুবিধার্থে আমরা অনেক কাজ ভাগ করে দফতরে, অধিদফতরে দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেই প্রক্রিয়া চলছে। এটা হয়ে গেলে কাজের গতি আরও বাড়বে।’ প্রশাসনের সংস্কারের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটি প্রক্রিয়াধীন। আর পদোন্নতিবঞ্চিতদের বিষয়ে আমরা নিয়মিতই বসছি। তাদের বিষয়টি দেখছি।’

সর্বশেষ খবর